বাংলার কুড়ি জন ঐতিহাসিক বাঙালি মহিলার তালিকা ও তাদের পরিচয়
রানী রাসমণি- কলকাতার জানবাজারের প্রসিদ্ধ জমিদার ছিলেন লোকমাতা রানী রাসমণি। তিনি ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাত্রী। তিনি জনকল্যাণমুখী কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন৷ তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেন৷ গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য তিনি বাবুঘাট, নিমতলা ও আহিরীটোলা ঘাট তৈরি করেন। তিনি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্ব মোটা অর্থ দান করেছিলেন।
মাতঙ্গিনী হাজরা- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতমা নেত্রী ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। ৭৩ বছর বয়সে তমলুক থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। হাতের মুঠোয় জাতীয় পতাকা আঁকড়ে ও বন্দেমাতরম ধ্বনি আওড়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি 'গান্ধীবুড়ি' নামে পরিচিত ছিলেন।
ডঃ পূর্ণিমা সিনহা- একজন সফল বাঙালি মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী হলেন ডঃ পূর্ণিমা সিনহা। তিনি প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে ডক্টরেট লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতের কাদামাটি ও খনিজগুলির এক্স-রে এবং ডিফারেনশিয়াল তাপ বিশ্লেষণ’ বিষয়ে গবেষণার জন্য এই ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
ডঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়- একজন সফল বাঙালি জৈব ও উদ্ভিদ রসায়নবিদ ছিলেন ডঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়। তিনি ভিনকা অ্যালকালয়েডের ওপর গবেষণা করেন৷ তিনি সর্বপ্রথম ম্যালেরিয়া ও মৃগীরোগের ঔষধ প্রস্তুত করেন।
সরলা দেবী চৌধুরানী- বাংলার বিশিষ্ট মহিলা বুদ্ধিজীবি ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ হলো 'নববর্ষের স্বপ্ন', 'জীবনের ঝরাপাতা', 'শিবরাত্রি পূজা'। তাঁর নেতৃত্বে এলাহাবাদে ভারতের প্রথম মহিলা সংগঠন 'ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল' প্রতিষ্ঠা হয়।
স্বর্ণকুমারী দেবী- বাংলার প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি ঔপন্যাসিক ছাড়াও ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি, সঙ্গীতজ্ঞ ও সমাজসংস্কারক। তিনি সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একজন সক্রিয় সদস্যা ছিলেন৷ অনাথ ও বিধবাদের সহয়তায় তিনি ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে 'সখীসমিতি' স্থাপন করেন৷
ডঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়- ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক হলেন ডঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক। কট্টর হিন্দুপন্থী সমাজের দ্বারা তিনি বারবার আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ 'বঙ্গবাসী' নামের একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ্যে তাকে বেশ্যা বলে অভিহিত করেছিল৷ তিনি এই পত্রিকা ও কট্টর হিন্দুপন্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে জয়লাভ করেছিলেন।
তরু দত্ত- প্রথম বাঙালি মহিলা তরু দত্ত যিনি ফরাসি ও ইংরেজি দুই ভাষাতে সমান দাপটের সঙ্গে সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি ফরাসি ভাষার দেড়শো কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। মাত্র একুশ বছরের জীবনকালে তিনি ইংরজি ও ফরাসি সাহিত্যে অভূতপূর্ব অবদান রাখেন৷
অবলা বসু- আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর স্ত্রী হলেন অবলা বসু। স্বামীর কীর্তিতে চাপা পড়ে যাওয়া এক নাম হলো অবলা বসু। যিনি নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্রতী ছিলেন৷ অবলা বসু নিজের ভাবনায় অবিচল থেকে নারীশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ প্রসাদ বসাকের সহযোগিতায় তিনি গঠন করেন নারী শিক্ষা সমিতি। পরবর্তী কালে তিনি গ্রাম-বাংলার বুকে প্রতিষ্ঠা করলেন দুশোটি বিদ্যালয়। তিনি বিধবা বিবাহের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন বিদ্যাসাগর বাণী ভবন, মহিলা শিল্প ভবন ও বাণী ভবন ট্রেনিং স্কুল। জগদীশ চন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর তাঁর প্রদত্ত এক লক্ষ টাকা ভগিনী নিবেদিতার নারীশিক্ষা উন্নয়নের খাতে অকাতরে বিলিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে 'অ্যাডাল্টস প্রাইমারি এডুকেশন সেন্টার' গড়ে তুলেছিলেন।
সারদা দেবী- শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী ছিলেন একজন মহিলা সংস্কারক৷ তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্ত্রী৷ রামকৃষ্ণ আন্দোলনের ভূমিকা ও বিকাশে তিনি অনস্বীকার্য অবদান রাখেন৷ তার সম্পূর্ণ জীবন পরিপূর্ণ ছিল স্বামী, ভ্রাতা ও ভ্রাতৃ-পরিবারবর্গ ও তার আধ্যাত্মিক সন্তানদের প্রতি সেবা ও আত্মত্যাগে। একজন মহীয়সী নারী হিসেবে দরিদ্র-আর্তপীড়িতদের জননী হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তিনি৷
মৈত্রেয়ী দেবী- বাংলা সাহিত্যের অসামান্য উপন্যাস 'ন হন্যতে'র লেখিকা হলেন মৈত্রেয়ী দেবী৷ তিনি সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বহু সামাজিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। কলকাতা থেকে ২৪ মাইল দূরে বাদু নামে একটি গ্রামে নয় বিঘা জমির ওপর শরণার্থী শিশুদের জন্য 'খেলাঘর' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন৷ তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার পান। এমনকি সাহিত্যে অবদানের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান৷ তাঁর বই ইংরেজি সহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষাতে অনুদিত হয়।
কামিনী রায়- বাংলার এক প্রথিতযশা কবি, সমাজকর্মী ও নারীবাদী লেখিকা ছিলেন কামিনী রায়। তিনি ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিত্ব। তিনি 'জনৈক বঙ্গমহিলা' ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার- ভারতের প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের একজন অন্যতমা নেত্রী ছিলেন। জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পূর্ব মুহূর্তে পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে নিয়ে আত্মঘাতী হন।
চন্দ্রমুখী বসু- দেশের প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। একই সাথে যুগ্ম ভাবে প্রথম স্নাতক হন চন্দ্রমুখী বসু। বাঙালি নারীরা যে কোনো অংশে কম নয় তার প্রমাণ তিনি বাঙালি বিদ্বেষিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন। ব্রিটিশ অধিকৃত দেশগুলোর মধ্যে তাঁরাই ছিলেন প্রথম স্নাতক।
বিনা দাস- ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতমা নেত্রী ছিলেন বিনা দাস। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীশ ভৌমিকের স্ত্রী ছিলেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের একজন নেত্রী ছিলেন। ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের ওপর গুলি চালান। এই ঘটনার জন্য তাঁর নয় বছরের জেল হয়৷ স্বাধীনতার পর মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
কল্পনা দত্ত- চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের একজন মহান নেত্রী ছিলেন কল্পনা দত্ত। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে পরিচিত হন৷ তিনি সূর্য সেন প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখায় যোগদান করেন। তাঁর বিপ্লবী মনোভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'অগ্নিকন্যা' বলে অভিহিত করেছেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর যাব্বজীবন কারাদণ্ড হয়।
মহেশ্বেতা দেবী- বাংলার এক প্রথিতযশা মহিলা সাহিত্যিক ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী৷ আদিবাসী, মুণ্ডা, শবর-লোধা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লড়াই নিয়ে তিনি উপন্যাস লিখতেন। 'অরণ্যের অধিকার', 'হাজার চুরাশির মা'র মতো অসংখ্য উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন তিনি৷ দেশ-বিদেশের বহু ভাষাতে তাঁর রচনাবলী অনুদিত হয়৷ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিদের অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়েছিলেন৷
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন- বাঙালির নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। নারীশিক্ষা বিস্তারে তিনি যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘোর বিরোধী ছিলেন। নারীদের অধিকার নিয়ে তিনি রচনা করে গেছেন অজস্র গ্রন্থাবলী৷ তাঁর রচিত 'সুলতানার স্বপ্ন' হলো নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্যের এক ক্লাসিক্যাল নিদর্শন।
আশাপূর্ণা দেবী- বাংলার প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হলো 'প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা', ও 'বকুল কথা'। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্ব ছিল তাঁর লেখার প্রধান বিষয়৷ তিনি দেড়শোর বেশি ছোটোগল্প ও আড়াইশোর বেশি উপন্যাস লিখেন।
অরুণা আসফ আলী- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতমা মহিলা যোদ্ধা ছিলেন অরুণা আসফ আলী। তাঁকে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনের নায়িকা' বলা হয়। সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষাবিদ ও প্রকাশক।
(নামের তালিকার তথ্য ও ছবি সন্দীপন মিত্রের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত)
প্রতিবেদন- লিটারেসি প্যারাডাইস ইনফরমেশন ডেস্ক
Post a Comment