চলচ্চিত্র যখন উপন্যাসকেও ছাপিয়ে যায়। ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত 'নৌকাডুবি' এ সত্যতাই বহন করে
"খেলাঘর বাঁধতে এসেছি, আমার মনের ভিতরে", হেমনলিনী তানপুরা হাতে এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি গাইছে। তার গান গাওয়ার এই দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে হেমনলিনীর প্রাণপুরুষ রমেশের একটি নতুন বাড়ি সাজানোর দৃশ্যের দেখা মিলতে থাকে। রমেশ বর্ণনা করছে তার ঘর গোছানোর দৃশ্য। এই দৃশ্যের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর কথা হলো "তুমি ঠাকুর দেবতাতে যতোই নাই বিশ্বাস করুন না কেন একজন ঠাকুর আপনার আপাতমস্তক ধারণ করেই ছাড়বে, তিনি হলেন রবি ঠাকুর।"
'নৌকাডুবি' ছবির প্রথম দৃশ্যটি খ্যাতনামা পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ কী দারুণ বুদ্ধিমত্তার সাথেই যুক্ত করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকেই কত সুন্দর করে তুলে এনেছেন এই ছবিতে। এমন পরিচালনার দক্ষতা খুব সংখ্যক পরিচালকের মধ্যেই বিদ্যমান। রবীন্দ্র উপন্যাস থেকে ছবি বানাতে গেলে গানের ব্যবহার করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের মধ্যে সঠিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যবহার করে এক একটা মাস্টারপিস তৈরি করতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
'নৌকাডুবি' ছবিও নিঃসন্দেহে একটা মাস্টারপিস। পুরো ছবি দেখলে সকলের এটাই মনে হতে পারে। পুরো ছবি আবেগের বন্যায় সহজে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক একটা মানুষকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি আশ্চর্যকর উপন্যাস হলো 'নৌকাডুবি'। সুখ-দুঃখ, অভিমান ও প্রেম-ভালোবাসার বৈচিত্র্যে ভরা একটি সতেজ উপন্যাস হলো 'নৌকাডুবি'। কোনো এক কালবৈশাখীর ঝড়ে বদলে যায় চার ব্যক্তির জীবন। ভাগ্যকে মুখ বুজে মেনেও নেয় এই চার ব্যক্তি। ভাগ্য যেন কখনো সুখ দেয়না তাদের তবুও ভাগ্যকে দোষারোপ না করে জীবনে সুখ খোঁজার চেষ্টা করে তারা।
নৌকাডুবিতে আমরা দেখতে পাই রমেশ শহরে ব্যস্ত তার পড়াশোনা ও প্রেম-পর্ব নিয়ে। হঠাৎ একদিন তার বাবার এক চিঠি পায় রমেশ। যেখানে তাকে একবার পিতৃগৃহে আসার কথা বলা হয়। রমেশ বাবার আজ্ঞা পালন করতে ছুটে আসে পিতৃগৃহে। রমেশ গৃহে এসে জানতে পারে তাকে না জানিয়ে বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছেন। রমেশ জানায় যে সে হেমনলিনীকে বিয়ে করার জন্য কথা দিয়েছে। কিন্তু তার বাবা নিজের দম্ভ থেকে এতটুকুও নড়লেন না। রমেশ স্থির করে বসে সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। বাবাও তাকে নির্দেশ দেন সে আজকে গৃহত্যাগ করলে আর যেন না ফিরে আসে৷ রমেশ নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে কিন্তু তার বাবা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন তার বিধবা মামির এক বাক্যালাপে রমেশের অন্তর ছিঁড়ে যায়। সেই বিধবার মুখ চেয়ে রমেশ বাবার সম্বন্ধ করা পাত্রী সুশীলাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
সুশীলাকে বিয়ে করে ফেরার সময় প্রচণ্ড এক ঝড়ে নৌকাডুবিতে সব এলোমেলো হয়ে যায়। তারপর যে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে সেখানেই গল্প আলাদা রূপ নেয়। বাকী অংশের কথা তো কম-বেশি সকলেরই জানা। ঋতুপর্ণ ঘোষ এই উপন্যাসের চলচ্চিত্রে রূপায়ণ ঘটিয়ে যেন একটা মহাকাব্য তৈরি করেছিলেন। গানের ব্যবহার, কালার গ্রেডিং, অভিনয়, স্থান-কাল-পাত্র নির্বাচন কোনোকিছুতে এক টুকরো খামতি রাখেননি তিনি। এটাই তাঁর এক অনন্য বিশেষত্ব।
তাঁর পরিচালিত 'নৌকাডুবি' ছবিটি উপন্যাসকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। হেমনলিনীর চরিত্রে রাইমা সেন, রমেশের চরিত্রে যীশু সেনগুপ্ত, নলিনাক্ষের চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, কমলার চরিত্রে রিয়া সেন, হেমনলিনীর বাবা অন্নদাবাবুর চরিত্রে ধৃতিমান চ্যাটার্জী, সুশীলার মামির চরিত্রে লাবণি সরকার, রমেশের বাবা ব্রজমোহনের চরিত্রে সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, এই যে উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন সত্যিই লাবণ্যময়।
উপন্যাসের মূল গল্পের বিষয়বস্তু এক রেখে দু'একটা পার্শ্বচরিত্র বাদ রেখে প্রধান চারটি চরিত্রকে কেন্দ্রবিন্দু করেই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ বাবু৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৌকাডুবি' উপন্যাসের থেকে 'নৌকাডুবি' চলচ্চিত্র হয়তো কিছুটা আলাদা তবে ঋতুপর্ণ বাবু ছবির অংশ জুড়ে গভীরতর সম্মান প্রদর্শন করেছেন কবিগুরুকে। উপন্যাস থেকে ছবি তৈরি হলে পরিবর্তন কম-বেশি সকলেই করেন। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষের এমন পরিবর্তন উপন্যাসগুলোকে আরো বেশি জীবন্ত করে তুলতো। ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত নৌকাডুবি বাংলা ছবিকে অন্যরকম মাত্রা দিয়েছিল। তাঁর পরিচালিত নৌকাডুবি ছবিটি রূপে-গুণে এক ও অদ্বিতীয়। ২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। মানে তাঁর মৃত্যুর ঠিক দুটি বছর আগে। তাঁর পরিচালিত সেরা ছবির তালিকায় ভেসে আসে এ ছবির নামও।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment