ভারতের প্রথম কীট-পতঙ্গের বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য || তৃতীয় পর্ব
আমরা আগের পর্বে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে শ্রীগোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের সাক্ষাতের কথা জানলাম। ১৯১৭ সালে আচার্য বসু এ দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে একটি বিজ্ঞানের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যার নাম ‛বসু বিজ্ঞান মন্দির’। বলাবাহুল্য, আচার্য বসুর নামাঙ্কিত এই বিজ্ঞানের মন্দির তার সমৃদ্ধশীলতা ও উচ্চ মানের গবেষণার জন্য দেশের মধ্যে তো বটেই এমনকি সারা বিশ্বে নামী বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিজ্ঞান মন্দিরটি ছিল আচার্য বসুর আজীবন লালিত স্বপ্নসৌধ। তা আচার্য বসুর লালন করা স্বপ্নসৌধ হিসেবে গঠিত এই সুপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞান মন্দিরের একজন বিশেষ পুরোহিত হিসেবে বা বলা যায় একজন বিশেষ বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য যোগদান করেন। সেখানকার ওয়ার্কশপে তিনি নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর শেখার স্পৃহা সর্বদাই জাগ্রত ছিল। আর তাই, সরকারি আর্ট কলেজে কিছুদিন ছবি আঁকা শিখেছিলেন। ব্লক তৈরিও শিখেছিলেন। তাঁর এই দুটি বিষয়ের জ্ঞান কাজে লাগলো বই ও সাময়িকীর ক্ষেত্রে ইলাসট্রেশনের জন্য। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত আচার্য বসুর ‘Plant Autograph and their Revelations’ এবং ১৯২৮ সালে প্রকাশিত ‘Motor Mechanism of plants’ এই দুই বইয়ের ইলাসস্ট্রেশন এঁকেছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। পরেও, বিজ্ঞান সাময়িকী সম্পাদনার জন্যে বহু ছবি তাঁকে আঁকতে হয়েছিল। বলাই যায় যে, বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গোপালচন্দ্রকে যন্ত্রপাতির কলাকৌশল, ছবি আঁকা, ব্লক তৈরির মতো নানা ধরণের কাজ করতে হত। এমনকি মাঝে মাঝে উদ্ভিদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হত তাঁকে।
গোপালচন্দ্র প্রথম জীবনেই আচার্য বসুর মতো একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞান সাধকের সাহচর্য লাভ করেছিলেন। আর এই সাহচর্যের ফলেই তাঁর বিজ্ঞান সাধনায় বিপুল অগ্রগতি ঘটেছিল যার দরুণ তিনি একগুচ্ছ উচ্চমানের গবেষণাপত্র তিনি প্রকাশ করে বিজ্ঞানের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে দেখা দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সাল পর্যন্ত আচার্য বসুর নামে সমস্ত গবেষণাপত্র ছাপা হত এবং বাকি লেখকদের বা ইলাসট্রেটরদের নাম সহকারী হিসেবে রাখা হত। কিন্তু ওই সময় থেকে আচার্য বসু সবাইকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বললেন। গোপালচন্দ্রের কাছে ওই সময়টা ছিল ঠিক যেন এক ‛টার্নিং পয়েন্ট’। গোপালচন্দ্র সেই সময় ঠিক করলেন যে আর গাছপালা নিয়ে তিনি কাজ করবেন না। আর তখন তিনি কীটপতঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের কাজ বিশেষ করে তাদের আচার-আচরণ, ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। তিনি কাজ শুরু করলেন নানা প্রজাতির পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ যেমন প্রজাপতি, পিঁপড়ে ও মাকড়সাদের নিয়ে। এইসব পোকামাকড় বা কীটপতঙ্গের বহিরাকৃতির বৈশিষ্ট্য, খাদ্য সংগ্রহ, আত্মরক্ষার কলাকৌশল ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। আর এইসব পর্যবেক্ষণের ফলে তিনি সমগ্র সমাজকে উপহার দিতে লাগলেন নিত্যনতুন তথ্য। প্রজাপতি, পিঁপড়ে ও মাকড়সা ছাড়াও তিনি শুঁয়োপোকা, অন্যান্য পোকামাকড় এমনকি পরবর্তীকালে ব্যাঙাচি নিয়েও পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের পর আচার্য বসুর সকল গবেষককে স্বাধীনভাবে কাজ করার উপদেশ দেওয়ার পর, ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল এই দশ বছরে গোপালচন্দ্রের ষোলোটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাঁর বিভিন্ন গবেষণাপত্রগুলী বসু বিজ্ঞান মন্দিরের 'ট্রানজ্যাকশন', বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির 'জার্নাল অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি', স্বনামধন্য বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা প্রতিষ্ঠিত 'সায়েন্স এণ্ড কালচার', 'আমেরিকান সাইন্টিফিক মান্থলি', 'ন্যাচারাল হিস্ট্রি ম্যাগাজিন' ইত্যাদি সুপ্রসিদ্ধ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
একথা উল্লেখযোগ্য যে, গোপালচন্দ্রের গবেষণার বিষয়গুলি ছিল অভিনব, নতুনত্বে ভরপুর। গর্বের বিষয় যে, গোপালচন্দ্র যে ধরণের গবেষণার কাজ করতেন তা বসু বিজ্ঞান মন্দির কেন এদেশের আর অন্য কোথাও হত কিনা সন্দেহ। তাঁর কাজ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানীরও দৃষ্টি এতটাই আকর্ষণ করত যে, বিজ্ঞানী বসু শত ব্যস্ততার মধ্যেও গোপালচন্দ্রের কাজ সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসাহী ও আগ্রহী ছিলেন। তাঁর এই উৎসাহ ও আগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রাক্তন সহ-অধিকর্তা এন সি নাগ মহাশয়কে লেখা আচার্য বসুর একটি চিঠির অংশ থেকে। সেই চিঠিতে আচার্য বসু লিখছেনঃ-
"I am glad that Gopal is sending the two papers for the Bombay Natural History Society. This will bring him in touch with other workers on similar line, and he can exchange notes with them."
Post a Comment