রাজ্যপাল ভালো করে মাতৃভাষা জানেন না তাই রাজভবনে কখনও পা মাড়াননি আমাদের প্রিয় ভানুদা
বাংলা সিনেমায় কমেডিয়ান চরিত্র গুলো অনেকটা গোঁজ প্রার্থীর মতো। ভোটে জিতবে না...কিন্তু অনেকটা ভোট কেড়ে নেবে। বাংলা সিনেমায় কমেডিয়ান বলে আমরা যাদের চিহ্নিত করি তাদের মধ্যে তিনি তাঁর সময় এ এক এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সাম্যময় বন্দোপাধ্যায় ওরফে ভানু বন্দোপাধ্যায়। সাম্যময় নাম তাঁর সওদাগরি পে-স্লিপ এই থেকে গেলো। আমাদের কাছে ভানু বন্দোপাধ্যায়...নিজেকে তিনি 'ভানু -ভাঁড়' বলতেই পছন্দ করতেন।
সময়টা চল্লিশের দশক। ঢাকা শহর জুড়ে রাজনীতির হাওয়া গরম। যুবক যুবতী দের কাছে পরাধীনতার বেড়ি অসহ্য হয়ে উঠছে। ঢাকা শহরে এই সময় পুলিশ এর এক কুখ্যাত ইনফর্মার খুন হয়ে যায়। পুলিশি হুজ্জুতি থেকে বাঁচতে কলকাতায় চলে আসেন। আসতে চাননি কিন্তু পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে একরকম আপস করতে হয়। কলকাতায় এসে দিদির বাড়িতে উঠলেন। কিন্তু কলকাতায় পা দিয়ে একদিনও বেকার থাকেননি। জামাইবাবুর সুপারিশ এ ডালহৌসির অফিস পাড়ায় চাকরিতে ঢুকে যান।
দাদু নাম রেখেছিলেন সাম্যময়। এই নাম নিয়ে তাঁর গর্বের অন্ত ছিল না। বুক ঠুকে অনেকের কাছেই বলতেন "দাদু ওতো বছর আগে এমন একখান নাম রেখেছিলেন... সেই বাড়ির ছেলে বড় হয়ে সাম্যবাদী বাম রাজনীতি করবে.. সেই ব্যাপারে কি সন্দেহ আছে??"
স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গৌরবজনক অধ্যায় 'রাইটার্স অভিযান'। অত্যাচারী কর্নেল এন. এস. সিম্পসন কে হত্যা করার ছক। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে সাইকেল এ চাপিয়ে পৌঁছে দিলেন ডালহৌসি স্কোয়ারে। কমেডিয়ান এর বিপুল খ্যাতির আড়ালে তাঁর এই কর্মকান্ড আজও চাপা পড়ে থেকে যায়।
ছিন্নমূল যন্ত্রনা বুকে নিয়ে কলকাতা এসে নিজ ডাইলেক্ট এ, নিজ অ্যাকসেন্ট এ একরকম মস্তানি করেছেন। ওপার বাংলার চালচলন, স্বকীয়তা, ভাষা বজায় রেখেই এপারে দাপিয়ে রাজত্ব করেছেন। মাতৃভাষা না জানা মানুষকে অপরাধী বলে মনে করতেন। মামা বাড়ির সম্পর্কে আত্মীয় ছিলেন সরোজিনী নাইডু ৷ ভানু যখন কলকাতায় প্রতিষ্ঠার লড়াই লড়ছেন তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে আসেন পদ্মজা নাইডু। কিন্তু কোনোদিন রাজভবন এর দিকে পা মাড়াননি। কারণ পদ্মজা নাইডু প্রসঙ্গে বলেছিলেন "উনি ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ পড়েন.. নিজের মাতৃভাষা জানেন না ভালো করে... ওঁর সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছে নেই"। নিজের ভাষার প্রতি এই অভিমান আজীবন জারি ছিল।
সুচিত্রা সেনের বাড়ি অবারিত দ্বার ভানুর জন্য। এতটাই গভীর বন্ধুত্ব যে তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল। বাঙাল ভাষায় হাসি ঠাট্টা করে দেশজ আত্মীয়তা কে ঝালিয়ে নিতেন। বাঙাল ভাষাকে একরকম সিগনেচার করে তুলেছিলেন। সুচিত্রা সেনের কথায় বাঙালী হয়ে জন্মানোর জন্য এতো আহ্লাদ ও গর্ব ভানু ভিন্ন কাওকে দেখলাম না। একদিন জনৈক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথোপকথন চলছে। ভানু জিজ্ঞেস করলেন "আপনি কি???" ভদ্রলোক- "বাঙালী !!! আপনি???" দাপটের সঙ্গে ভানুর উত্তর "বাঙাল !! আপনি স্ত্রী লিঙ্গ !! আমি পুং"
বাংলা জুড়ে অসংখ্য তারকা শোভিত ছবির সমাহার। সেই চাঁদের দেশেও ছবি তৈরী হলো 'ভানু পেলো লটারি', 'ভানু গোয়েন্দা জহর এসিট্যান্ট' জীবদ্দশায় কোনো শিল্পী জনপ্রিয়তার কোন আসনে থাকলে তাঁর নাম মাহাত্ম্যে সিনেমা তৈরী হয়। বিশ্ব সিনেমায় যা বিরল। যা এই বাঁড়ুজ্জে করে দেখিয়েছেন।
ঢাকায় থাকাকালীন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান এ মোটামুটি পরিচিতি পেয়েছিলেন। বন্ধু আড্ডা থেকে জলসার মঞ্চ শো করতেন। কলকাতায় আসার পর চাকরি করতেন 'আয়রন এন্ড স্টিল' কোম্পানি তে। সিনেমার জগতে পার্টটাইমার হয়ে ঢুকেছিলেন।বিয়ের পর দ্বিরাগমনে গিয়ে শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী নীলিমা কে রেখেই জীবনের প্রথম ছবি 'জাগরণ' এর শুটিং এ গিয়েছিলেন। এরপর অভিনয় করলেন 'নতুন ইহুদি' সিনেমায়.... কিন্তু সবগুলোই খুচরো রোল। এরপর ই উত্তম সুচিত্রার প্রথম পর্দা রোমান্স 'সাড়ে চুয়াত্তর' এ "মাসিমা মালপো খামু" বলা 'কেদার' চরিত্র বাংলা সিনেমার চিরকালের চরিত্র হয়ে উঠলো। এরপর ধীরে ধীরে ব্র্যান্ড ভানু হয়ে উঠলো 'পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট', 'মিস প্রিয়ংবদা', 'আশি তে আসিও না' এই সিনেমা গুলোতে। যেখানে পুরো ইনিংস টাই তিনি টেনে নিয়ে গেছেন।
অভিনেতা জহর রায় ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। নাটক, সিনেমা, জলসা এই নিয়েই বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়। জহর রায় এর স্ত্রীর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, আমাদের বাড়ি আয়তনে ছোট। জায়গার অভাব বলে বাড়ির কাছেই 'অমিয় নিবাস' বলে একটা বোর্ডিং ভাড়া নিয়ে ছিলেন। যেখানে দুজন নিভৃতে আড্ডা দিতে পারতেন। তবে দুই বন্ধুর বেশ কিছু বাহ্যিক বিরোধ ছিল। জহর পরতেন প্যান্ট -শার্ট, ভানু পরতেন ধুতি পাঞ্জাবী। জহর খেতেন পান ভানু মুহুর্মুহু সিগারেট টানটান। তরল এর ব্যাপারে জহর কোনো মাত্রা রাখতেন না, ভানু ঠিক উল্টো, কিন্তু এই দুজন কিংবদন্তির নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতো বলেই এই জুটি নিয়ে তৈরী হয়েছিল 'ভানু গোয়েন্দা জহর এসিস্টেন্ট' ...যা ছিল এই জুটির শেষ নির্মল হাস্যরসের ছবি।
ঢাকা থেকে জেদ কে সম্বল করে কলকাতায় এসে বিনোদন বাণিজ্যের নানা চোরাগলি পেরিয়ে বিখ্যাত সিনেমা 'কৌতুক নকশা' তে তিনি কলকাতার 'বাবু -তাচ্ছিল্যের' মুখের ওপর বলেছিলেন "দ্রিমু য্রখন, ত্রখন স্রব টাতেই দ্রিমু"।
এমন বাঙালিপনা, ইস্ট বেঙ্গল মোহনবাগান এর দৈরথ, চিংড়ি -ইলিশ ঝগড়ার মধ্যেও বাঙালী শিরদাঁড়ার কমন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভানু বাঁড়ুজ্জে। যিনি ভাঁড় নন, আমাদের হেসে ওঠার অফুরান ভাঁড়ার।
Post a Comment