Header Ads

'ঘেটুপুত্র কমলা' ছবির মাধ্যমে 'ঘেটু' গানে অপসংস্কৃতি ভর করার ঘটনা জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়


নদীতে ভরা আমাদের দুই বাংলা। এই নদীর দুই দেশে চলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। পয়লা বৈশাখ থেকে চৈত্রের অন্তিম দিন পর্যন্ত চলে বাঙালির নানান উৎসব। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে প্রচলন ঘটে 'ঘাটু' নামের একটি বিশেষ পল্লীসঙ্গীতের। যা নববর্ষে প্রধানত গাওয়া হতো। সিলেট, হাওড়, ময়মনসিংহ থেকে দল আনিয়ে গাওয়া হতো এই গান। সঙ্গে বাইজির আসরও বসানো হতো। যেখানে অনেক পুরুষকে বাইজি সাজানো হতো। প্রথমদিকে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই গান। কিন্তু পরবর্তীকালে অশ্লীলতা ভর করে এই গানে।


পশ্চিমবঙ্গের নদী অঞ্চল ও বাংলাদেশের হাওড়ের এক বিলুপ্তপ্রায় পল্লীসঙ্গীত হলো 'ঘাটু' গান। নদীর ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান গাওয়া হতো বলে একে 'ঘাটু' গান বলা হতো। প্রাচীনকালে নববর্ষ পালনে ঘাটু সংস্কৃতির যোগসূত্র ঘটে। 'ঘাটু' গানের সাথে উপভোগ্য বিষয় ছিল এ গানের নাচ। একটা অল্প বয়সী নাবালক ছেলেকে মেয়ে রূপে সাজিয়ে নাচের কিছু সহজ মুদ্রা শিখিয়ে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে বাইজিদের অনুষ্ঠানের মতো করে ঘাটুর আসর জমানো হতো। বাংলার ঢোল, মন্দিরা, বাঁশি, বেহালা ও হারমোনিয়ামের ব্যবহার হতো ঘাটু গানে৷ বাড়ির মতো করে গোল প্যান্ডেল বানিয়ে তার ভেতরে শ্রোতারা উপভোগ করতেন এই গান। ঘুঙুর পায়ে বাইজি সেজে নাবালক ছেলেরা নাচার সময় কেউ কেউ তাদের দিকে টাকা-পয়সাও ছুঁড়ে দিতো।

'ঘাটু' গানের এক সময় গগনচুম্বী খ্যাতির পরও ক্রমশ হারিয়ে যায় 'ঘাটু' গান। এর মূল কারণ হলো ঘাটুদের কেনাবেচা ও তাদের দর্শকদের সামনে নোংরা ভাবে প্রদর্শন করা। ধীরে ধীরে 'ঘাটু' গান অপসংস্কৃতির আখড়া হয়ে উঠেছিল। সমাজের নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে থাকে 'ঘাটু' বা 'ঘেটু' গানকে কেন্দ্র করে। সমকামী সমস্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে 'ঘেটু' গানকে কেন্দ্র করে। 

কালজয়ী সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এই বিষয়টির প্রেক্ষাপটে 'ঘেটুপুত্র কমলা' নামে একটি ছবি নির্মাণ করেন। এটাই ছিল তাঁর পরিচালিত সর্বশেষ ছবি। 'ঘেটুপুত্র কমলা' মুক্তির আগে তিনি দর্শকদের অনুরোধ করেছিলেন যাতে এই ছবি ছোটোদের না দেখানো হয়। এর বিশেষ কারণ হলো ঘাটু গানে ছেলেদের মেয়ে সাজানো হতো। অনেক জমিদার এই ছেলেদের সাথে যৌনকার্যেও লিপ্ত হতো। এগুলো দেখলে শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাবে পড়তে পারে। সিনেমা জগতে বিভিন্ন বয়সের জন্য বিভিন্ন সিনেমা বানানো হয়। অতএব দর্শকদের সমস্ত সিনেমা যাচাই করে দেখতে হয়। 

'ঘেটুপুত্র কমলা' ছবিতে নির্দিষ্ট করে কোনো সময়কাল দেখানো হয়নি। কেবল শুরুতে বলে দেওয়া হয় যে আজ থেকে দেড়শো বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘাটু গান।২০১২ সালের ৭ ই সেপ্টেম্বর ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় মুক্তি পায় এই ছবি। ৮৫ তম অস্কার প্রতিযোগিতায় সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিল এই ছবি৷ 

ছবিটির গল্পে দেখা যায় হাওড় অঞ্চলে নদীর বুকে চর গজিয়ে উঠেছে। এই সময় এক জমিদার বিনোদনের জন্য নানারকম উদ্যোগের আয়োজন করছেন। নদীর ওপারের এক গ্রাম থেকে এক চিত্রশিল্পীকে ও ঘাটু গানের দলকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ঘেটুর আসল নাম 'জহির' কিন্তু ঘেটু নাম কমলা। সে একটা বাচ্চা ছেলে। জমিদার বাড়িতে আসার আগে ভালো ভাবে শেখা হয়নি তার গান ও নাচ। সে জানতো না জমিদার বাড়িতে তিনমাস ধরে তাকে এক কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। সে তার বাবার সাথে জমিদার বাড়িতে আসে৷ জমিদারের সাথে প্রথম সাক্ষাতে জমিদার তাকে বলেন যেন নাচটা সে যেন ভালোভাবে আয়ত্ত করে। তাকে মেয়ে সাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় জমিদারের স্ত্রীর ওপর। সে যুগে এই ঘেটুদেরকে সতীন ভাবা হতো। কারণ প্রতি রাত্রে এই ঘেটুদের সাথে জমিদাররা যৌন কার্যে লিপ্ত থাকতো। জমিদারের স্ত্রী কমলাকে খারাপ চোখে দেখতে থাকেন। জমিদারের মেয়ে কমলাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সে ছেলে হয়ে কেন মেয়ে সাজে বুঝে উঠতে পারে না। তাই সে তার মাকে জিজ্ঞাসা করে যে কমলা ছেলে না মেয়ে। তার মা মেয়ের প্রশ্নটা উড়িয়ে উত্তর দেয় সে কমলার সাথে যেন মেলামেশা না করে। 

প্রতি রাতে কমলার ওপর জমিদার নির্যাতন চালাতে থাকে। কমলার কোনো কিছু ভালো লাগছিল না৷ জমিদারের স্ত্রীর তার প্রতি অনাচার, জমিদারের অশালীনতা তাকে বিরক্ত করে তুলেছিল৷ সে সর্বদা বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে থাকে। তার বাড়িতে মা-বোন একা একা কীভাবে দিন কাটাচ্ছে সে কথাও চিন্তা করতে থাকে। একদিন ভোরে তারা মা-বোন তার সাথে দেখা করতে আসে৷ কমলার সাথে দেখা করার পর পর কমলার বাবা তার মা-বোনকে ফিরিয়ে দেয়। সে হয়তো জানতো না মা-বোনের সাথে ওটাই তার শেষ দেখা। 

জমিদারের স্ত্রী বাড়ির চাকরানীকে উপঢৌকন দিয়ে নির্দেশ দেন কমলাকে হত্যা করার। তাকে এমনভাবে হত্যা করতে হবে যাতে লোকে সেটাকে খুন না মনে করতে পারে। কমলার মন ছিল অতি চঞ্চল। সে ছাদের ওপরে ছাদের পাঁচিলের বেয়ে ঘুরে বেড়ায় মাঝে মধ্যে। জমিদারের স্ত্রী তার চাকরানীকে বলেন 'কমলা যখন ছাদের পাঁচিলের ওপর চলাফেরা করবে, সেই সময় তাকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে যেন মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়।' জমিদারের স্ত্রী একদিন রাতে কমলাকে সাজানোর সময় তাকে হাঁ বায়তে বলে৷ কমলা হাঁ বাওয়ার পর তার মুখের ভেতরে থুতু ছিটিয়ে দেয় জমিদারের স্ত্রী। এর পরের দিন চাকরানী কমলাকে আদর করে ছাদে নিয়ে যায়। কমলা ছাদের পাঁচিলের ওপর চলাফেরা শুরু করে দেয়। অকস্মাৎ সেই চাকরানী ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয় কমলাকে। ছাদ থেকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় কমলা। তার শরীরের লাল রক্তে ভেসে যায় বাড়ির উঠোন। এই দৃশ্য জানালা থেকে দেখে নেন জমিদার বাড়িতে আসা এক চিত্রশিল্পী। তিনি জমিদারকে বিষয়টি জানিয়েও দেন। জমিদার বিষয়টি জানার পর চিত্রশিল্পী, গানের দল সকলকে টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন। ঘেটুদের দল কমলার শোকে কাঁদতে কাঁদতে নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে থাকে। 

ঘেটুগানে অপসংস্কৃতি ভর করার ফলে বহু বাঙালি মায়ের কোল খালি হয়ে যেত। কমলার মায়ের মতো বহু মাকে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিদারুণ ভাবে সইতে হতো৷ হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত এই ছবিতে ঘেটুগানের দৃষ্টান্ত জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে 


No comments