উপেন্দ্রনাথ দাসের নাটকের ভয়ে ব্রিটিশ সরকারকে নাটক নিয়ন্ত্রণের আইন নিয়ে আসতে হয়েছিল
সাম্রাজ্যবাদ হোক বা আধিপত্যবাদ বা রাজনৈতিক দুষ্কর্ম বা সামাজিক অবক্ষয় বা জাতীয়তাবাদের বিকাশ সব ক্ষেত্রেই নাটক ও থিয়েটারের ভূমিকা চিরন্তন। ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে শত শত নাটকে অভিনয় করেছে বাঙালি। ‘নীলদর্পন’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রো’, ‘সরোজিনী’, ‘চা-কর-দর্পন’, ‘পুরবিক্রম’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘জমিদারদর্পন’ এরকম বহু নাটক ব্রিটিশ শোষণের রূপ তুলে ধরে ব্রিটিশ শাসকদের বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল।
বহু নাট্যগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল সমগ্র বাংলায়। বাংলার পাশাপাশি এই নাটকদল গুলি তাদের শাখা বিস্তার শুরু করে সারা ভারতের বিভিন্ন শহরে। বই, পত্রপত্রিকার মতো নাটক সারা দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৮৫০ এর পরবর্তী সময়ে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয়তাবাদে এই সমস্ত নাটক গুলির ভূমিকা ছিল অন্যতম।
এই নাট্য আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন উপেন্দ্রনাথ দাস।যিনি ছোটো থেকেই মুক্ত চিন্তাধারার পক্ষে লড়াই করেছেন।তিনি ছিলেন একজন নাট্যপরিচালক, নাট্যকার এবং সমাজ সংস্কারক। ওনাকে বাংলা নাট্যমঞ্চে জাতীয়তাবাদী নাটকের পথিকৃত বলা হয়।তিনি নাট্যপরিচালনা বা নাট্যঅভিনয়ের চেয়েও বেশি খ্যাতি লাভ করেছিলেন ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে নির্ভীক ও সাহসী নাটকের জন্য। এক কথায় বলতে গেলে তিনি ব্রিটিশদের অত্যাচারের স্বরূপটি হাঁটে হাড়ি ভেঙে দেখিয়ে দিতেন। ওনার পিতা ছিলেন উকিল শ্রীনাথ দাস। উপেন্দ্রনাথ দাস সংস্কৃত কলেজের ছাত্র তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে এক্কেবারে পাত্তা দিতেন না।ওনার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর উনি এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেন যার ফলে ওনার সাথে ওনার বাবার মনোমালিন্য হয় কিন্তু উনি গোঁড়ামিকে কখনও পাত্তা দেননি তাই নিজের বাড়ি ছেড়ে কাশিতে বসবাস করতে শুরু করেন।যদিও পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং শিবনাথ শাস্ত্রীর মধ্যস্থতায় ওনার বাবা ওনাকে ক্ষমা করেন।
তিনি বরাবর সমাজের গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়েছেন। আগে নাটকে মেয়েদের অভিনয় করতে দিতনা তখনকার রক্ষণশীল সমাজে। এই সবে নাটকে মেয়েরা অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছেন তখন তিনি সেই সমাজের রক্ষণশীলতাকে আঘাত করেন নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে। ১৮৭৫ সালে তিনি গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের ডিরেক্টর হন তারপর তিনি সমাজসংস্কার মূলক ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করেন। তখন থিয়েটারে এই সবে অভিনয় শুরু হওয়ায় বেশিরভাগ মেয়েই ছিল পতিতা-পল্লী থেকে আগত। সাধারণ পরিবার থেকে আরো অনেক পরে মহিলারা অভিনয় শুরু করেন। ১৮৭৫ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারী উপেন্দ্রনাথ দাসের উদ্যোগে তাঁর থিয়েটারে অভিনেত্রী সুকুমারির (গোলাপ) সাথে অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ ঘটনার পর তখনকার সমাজে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়। দ্য ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ এই ঘটনার প্রশংসা করে। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ওনার লেখা ইন্ডিয়ান স্টেজ বইতে ওনাকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়াও সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি ইন্ডিয়ান র্যাডিকাল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি মোট পাঁচটি নাটক লিখেছিলেন যথা ‘শরৎ-সরোজিনী’, ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’, ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’, ‘দি পুলিশ অফ পিগ এন্ড শিপ’ এবং ‘দাদা ও আমি’। প্রথম দুটি নাটক উনি লিখেছিলেন দুর্গাদাস দাস ছদ্মনামে। প্রথম দুটি নাটকে কমেডি ও ব্যাঙ্গাত্মকতার সুরে পরাধীনতরা জ্বালা তিনি তুলে ধরেছিলেন সহজ সরল ভাবে। এই নাটক দুটিতে তিনি ওনার সমাজ ভবনা তুলে ধরেন উগ্র ব্রিটিশ বিরোধী চিন্তার মাধ্যমে। যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলসের ভারতের আগমণকে কেন্দ্র করে উনি ব্যাঙ্গাত্মক নাটক ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ লেখেন। ব্রিটিশ পুলিশদের তিনি শূকর এবং ভেড়ার সাথে তুলনা করে লেখেন ‘দি পুলিশ অফ পিগ এন্ড শিপ’।
উনি গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের ডিরেক্টর থাকার সময় একের পর এক ব্রিটিশ বিরোধী নাটক করান।অমৃতলাল বসুর লেখা ‘হীরকচূর্ণ’ নাটকে বরোদা রাজ্যে ইংরেজদের বেয়াদপী তুলে ধরেন। ঠিক তারপরই ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ ইংরেজদের রোষানলে পড়ে। গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার ও বেঙ্গল থিয়েটারের পর পর ব্রিটিশ বিরোধী নাটক দেখে ভয় পেয়ে যায় ব্রিটিশরা এবং অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করার পরিকল্পনা করে। ঠিক তারপর ১৮৭৬ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারী লর্ড নর্থব্রুক অভিনয় নিয়ন্ত্রণের অর্ডিনান্স জারি করেন ও ডিসেম্বর থেকে এই আইন কার্যকর হয়।
৪ ঠা মার্চ বাংলা নাটক 'সতী কি কলঙ্কিনী' চলাকালীন ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার ঘিরে ফেলে। গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের ডাইরেক্টর উপেন্দ্রনাথ দাস, ম্যানেজার অমৃতলাল বসু, মহেন্দ্রলাল বসু, শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, গোপাল দাস, রামতারণ স্যান্যাল ও মতিলাল সুর গ্রেপ্তার হন। উপেন্দ্রনাথ দাস, ম্যানেজার অমৃতলাল বসুর একমাস কারাদন্ড হয়।ইন্ডিয়ান অ্যাশোসিয়েসন, হিন্দু মেলার সমর্থরা অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের কড়া সমালোচনা করে।বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা একে দমন-পীড়নমুলক আইন বলে অভিহিত করে। জমিদারদের সংগঠনদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন এই আইনটি নিয়ে নীরবতা পালন করে, যার ফলে তখনের জাতীয়তাবাদীরা জনসমর্থনে ব্যর্থ হন ও এই কালো আইন জারি হয়।
তথ্যসূত্র- বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস-দর্শন চৌধুরী, রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী- অমিত মৈত্র
Post a Comment