Header Ads

ভারতের প্রথম 'লিজিয়ঁ দ্য অনার' প্রাপক দুর্গাচরণ রক্ষিতকে কী চেনেন?


পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হলো চন্দননগর। বলা চলে এই শহর বাংলার মাঝে এক টুকরো ফ্রান্স। চন্দননগরে পা রাখলেই মাটি থেকে বেরিয়ে আসে ইতিহাসের গন্ধ। ফরাসিরা প্রথম ঔপনিবেশিক স্থাপন করেছিল এই চন্দননগরের বুকেই। চন্দননগরে ব্রিটিশদের সাথে ফরাসিদের যুদ্ধও হয়েছিল। এই চন্দননগরের ফরাসডাঙ্গাতে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি একদা বসবাস করতেন। বাংলার সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের বিশেষ উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্যও বিখ্যাত চন্দননগর। উৎসব-অনুষ্ঠানে যে উন্নতমানের লাইটিং ব্যবহৃত হয়, তারও আঁতুড়ঘর এই চন্দননগর। 


ব্রিটিশরা বাংলাকে পরাধীন করার পরও চন্দননগর ছিল ফরাসিদের অধীনে। ফরাসি আমলে প্রভূত উন্নতি হয় হয় চন্দননগরের। এর আদিনাম ছিল চাঁদেরনগর। শহরের মানচিত্রের আকৃতি অনেকটা চাঁদের মতো। তাই এই জায়গার নাম ছিল চাঁদেরনগর। কলকাতার মতো এখানেও আছে স্ট্র্যান্ড, বড়বাজার, বাগবাজার, বউবাজার। ফরাসি উপনিবেশ হওয়ার কারণে বিপ্লবীরা গোপনে আশ্রয় নিতেন চন্দননগরে। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অরবিন্দ ঘোষ ও তার অনুগামীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কর্মীরা, বিপ্লবী গনেশ ঘোষ, শহীদ জীবন ঘোষাল ও বিপ্লবী অনন্ত সিংহ আত্মগোপন করেন এখানে। শহীদ কানাইলাল বসুর শৈশবও কেটেছে এখানে৷ 

চন্দননগরবাসীদের মতে, চন্দননগরের অপূর্ব নান্দনিক স্থান হলো 'দুর্গাচরণ রক্ষিত ঘাট।' যারা এই ঘাটে গেছেন তারা লক্ষ্য করেছেন কী যে ঘাটের ওপরে একটি ফলকে কী লেখা আছে? ঐ ফলকে লেখা আছে 'মঁসিয়ে দৌরগা চারণ রাকুইট'। নামটা দেখে সবারই মনে হবে এটি কোন একজন ফরাসি ব্যক্তির নাম কিন্তু না এটা কোনো ফরাসি ব্যক্তির নাম নয়। তিনি হলেন বাঙালি বণিক দুর্গাচরণ রক্ষিত। যিনি ভারতের প্রথম 'লিজিয়ঁ দ্য অনার' প্রাপক৷ চন্দননগরের এক কিংবদন্তির নাম দুর্গাচরণ রক্ষিত। 

উনবিংশ শতকের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন দুর্গাচরণ রক্ষিত। চন্দননগরের লাল বাগানে আজও দণ্ডায়মান তাঁর বিশাল 'রক্ষিত ভবন'। ব্যবসা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তিনি চন্দননগর ছাড়িয়ে গোটা বাংলাতে খ্যাতি লাভ করেন। বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুর্গাচরণ রক্ষিতের নামও সবার প্রথমে উঠে আসে। গোটা বাংলা জুড়ে ব্রিটিশ শাসন ও চন্দননগরে ফরাসি শাসন, এমন অবস্থার মধ্যে থেকেও তিনি হয়ে ওঠেন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী।

লালবাগান বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন দুর্গাচরণ রক্ষিত। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর পিতা গোবিন্দ চন্দ্র কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে গত হন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে 'ক্যামা সাহেবের কোম্পানি'তে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসা শেখেন। পরবর্তীকালে তিনি এই কোম্পানিতে চাকরি ত্যাগ করে তিনি হয়ে ওঠেন একজন উদ্যোগপতি। শুরু করে দিলেন তাঁত ব্যবসা৷ তিনি ব্যবসা করবার আগে থেকেই তাঁর পরিবার তাঁত ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিল। তাঁর পিতা সেভাবে ব্যবসাতে আগ্রহ না দেখালেও তিনি পারিবারিক ব্যবসার দিকেই পা বাড়ান।  

ফরাসডাঙ্গার বিখ্যাত তাঁত নিয়ে ছোট্ট ব্যবসা শুরু করবার পরও তিনি ব্যবসায়ীক আইকন হয়ে উঠলেন। সংবাদপত্রেও বেরোতে লাগলো তাঁকে নিয়ে খবর। তিনি বিদেশে বস্ত্র, চাল,  ডাল, আফিমের মতো নানাবিধ সামগ্রী রপ্তানি করতেন। বিনিময়ে বিদেশ থেকে তিনি আমদানি করতেন ফরাসি মদ, কুইনাইন, জিঙ্ক হোয়াইটের মতো সামগ্রী। ব্যবসায়ীক সূত্রে ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, জামাইকা, হংকং, মরিশাস ও মিশরের মতো আভিজাত্যপূর্ণ দেশেও তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। 

ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি এতোটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে ব্রিটিশ আমলেও কয়েকজন ব্রিটিশকে তিনি বিদেশে ব্যবসার জন্য নিজের অফিসে কাজ দিয়েছিলেন। পরাধীন বাংলাতে এমন মানুষও ছিলেন, ভাবা যায়। তাঁর ব্যবসা অর্থের জোয়ারে এতোটাই ফুলে ফেঁপে উঠলো যে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ পর্যন্ত নিতে হলো। সাহেবদের সাথে তিনি দেখা করার জন্য গড়ে তুললেন 'সাহেবি বৈঠকখানা'।  

সেকেলের বাঙালি বণিকদের মধ্যে একটি জিনিস খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যেতো তারা একদিকে যেমন অর্থও উপার্জন করতো অন্যদিকে তাঁরা প্রচণ্ড দানবীরও হয়ে উঠতেন। আলামোহন দাশ, মতিলাল শীল, হাজী মহসিন প্রায় সকলেই ব্যবসায়ীর পাশাপাশি দানবীর হয়ে ওঠেন। তিনিও ব্যবসায়ীর পাশাপাশি দানবীর হয়ে ওঠেন। চন্দননগরকে তিনি মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন৷ চন্দননগরের উন্নতিকল্পে গরীবদের জন্য তিনি বিনামূল্যে ঔষধ দোকান খুলে দেন, বিনামূল্যে গরীবদের জন্য চাল-ডালের ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর শিক্ষক গোপালচন্দ্র দাসের সাহায্যে তিনি 'একল দুর্গা' নামের একটি ছেলেদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে 'দুর্গাচরণ রক্ষিত বঙ্গবিদ্যালয়' নামে পরিচিত। 

তিনি ১৮৮৩ সালে অবৈতনিক জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট হন৷ তাঁর বিদ্যানুরাগের জন্য প্যারিসের ফরাসি সাহিত্য পরিষদ তাঁর সম্মানিত সভ্যপদ অর্পণ করে পদক পাঠায়। ১৮৮৬ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে 'লিজিয়ঁ দ্য অনার' প্রদান করে৷ তিনিই হলেন প্রথম বাঙালি তথা প্রথম ভারতীয় 'লিজিয়ঁ দ্য অনার' প্রাপক৷ তিনি শেষ জীবনে চন্দননগরে একটি ঘাট বানাতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর জীবদ্দশায় এ কাজ সম্ভব হয়নি। পরে তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র শ্যামাচরণ রক্ষিত এই ঘাট নির্মাণ করেন। এ ঘাটের নামকরণ করা হয় 'দুর্গাচরণ ঘাট'। যা চন্দননগরের এক দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণ। 


তথ্যসূত্র- সংসদ বাংলা চরিতাভিধান

No comments