Header Ads

বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড ইতিবৃত্ত || সপ্তম পর্ব


আমরা বাঙালিরা বড়োই অনুকরণপ্রিয় অর্থাৎ অন্যদের অনুকরণ করাতে মেতে উঠি। এই অনুকরণ একেকটা সময় এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যে নিজেদের মাটি, ভাষা, শিল্প-সংস্কৃতি  ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ভুলে গিয়ে অন্য দেশের বা প্রদেশের শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদিকে আমরা যেন আঁকড়ে ধরি। অন্যদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে ভালোবাসা বা সম্মান করা খুবই ভালো কাজ কিন্তু তা বলে নিজেদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে অগ্রাহ্য, অবজ্ঞা বা ছোট করে দেখা মোটেও ভালো কাজ নয়। এখানে এমনও লোক দেখা গেছে যাঁরা অতি উচ্চশিক্ষিত কিন্তু গরমকালেও কোট-প্যান্ট, ব্লেজার পড়ে বসে থাকে। এমন মানুষও দেখা যায় যাঁরা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে পরের ভাষায় মেতে ওঠেন। সেই ভাষায় কথা বলার বা লেখার সময় ব্যাকরণগত বা উচ্চারণগত ভুল থাকলেও তিনি যেন সেটাই বলে আনন্দ পান। অনেকেই আছেন যাঁরা অতি উচ্চ-শিক্ষিত আবার নিজের জাতি বা মাতৃভাষা সম্পর্কে এক্কেবারে উদাসীন। লজ্জার ব্যাপার, বাঙালিদের মধ্যে এই কুৎসিত ও অপ্রীতিকর গুণগুলি বেশি দেখা যায়। আচার্যদেব ছিলেন এসবের ঘোরতর বিরোধী। তিনি বরাবরই নিজের মাতৃভাষা ও শিল্প-সংস্কৃতিকে সম্মান করে এসেছেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন গিলক্রাইস্ট স্কলার, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগৎবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র, দেশ-বিদেশের একাধিক মনীষীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, দেশ-বিদেশের প্রচুর সম্মান তিনি লাভ করেছিলেন। তবুও এত কিছুর মধ্যেও কোনোদিন নিজের মাতৃভাষা, নিজের জাতি ও নিজের জাতীয়তাকে ভুলে যাননি বা সেগুলোকে বিস্মৃতির সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জন দিয়ে দেননি। এই ‘মা’ বা বঙ্গমাতা তথা দেশমাতাকে অন্তর থেকে ভালোবেসেছিলেন, সম্মান করেছিলেন বলেই আজও তিনি, তাঁর সমস্ত কর্ম ও তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানগুলি দেশ ও দশের প্রশংসালাভে সমৃদ্ধ। তা তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের মধ্যে একটি খুব সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছিলেন যা গোটা বাঙালি সমাজে এক উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা উচিত। সেই ব্যবস্থার কথা বরং আচার্যদেবের ভাষাতেই পড়া যাকঃ-


“পুরো কারখানাতে একটি বিশেষ দেখার বিষয় কোথাও প্যান্ট কোট পরা সাহেব নেই। সর্বোচ্চ কর্মচারী থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সকলেই এদেশের লোক। কর্মচারীদের অভাব অভিযোগ জানাবার দরকার হলে তারা সোজাসুজি ম্যানেজার বা সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বলতে পারে। তাঁদের দেখা পাওয়া একেবারেই শক্ত ব্যাপার নয়। বেঙ্গল কেমিক্যাল পুরোপুরি বাঙালির প্রতিষ্ঠান। এখানে বাঙালির অর্থ,  বাঙালির বুদ্ধি, বাঙালির সামর্থ সবই বাঙালির। আমাদের দেশের যে সকল অতি পণ্ডিত লোকেরা বাঙালির কর্মকুশলতায় আস্থাবান নয়, তারা একবার বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা দেখে এলে বুঝতে পারবে, কেমন করে শুধু বাঙালিদের দিয়ে এত বড় কল কব্জার ব্যাপার চলতে পারে।” 

এভাবেই তিনি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসতেন ও বাঙালির উপর ষোল-আনা আস্থা রাখতেন। সবার উপরে তিনি বাঙালিকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতেন। যাইহোক, শুধু রাসায়নিক সামগ্রী প্রস্তুত করা নয়, বেঙ্গল কেমিক্যালের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক তুলে না ধরলে তাঁর কৃতিত্বের কথা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। তা হল সেই সময়, ব্রিটিশ আমলে গত কয়েক বছর ধরেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানি টিউব ওয়েল বা নলকূপ তৈরি করে চলেছিল। এই বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানি তৎকালীন সময়ে কলকাতা কর্পোরেশন, বেঙ্গল গভর্নমেন্ট, প্রচুর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড ইত্যাদির জন্য নলকূপ তৈরি করে দিয়েছিল। এই সবকটা নলকূপগুলি খুব ভালোভাবেই কাজ করত। এই নলকূপ তৈরির কাজের মাধ্যমে সামাজিক কাজেও বেঙ্গল কেমিক্যাল আচার্যদেবের আমলে কতটা পারদর্শী ছিল তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জানা গেল।

বেঙ্গল কেমিক্যালের কাজের সাথে স্থানেরও আরও পসারণ ঘটেছিল। সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি দেশের ইংরেজ সরকারও খুব খুশি ছিল বেঙ্গল কেমিক্যালের কাজকর্মে। কলকাতা থেকে প্রায় আট মাস দূরে, ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের উপর পানিহাটিতে বাংলা গভর্নমেন্ট ৮৫ বিঘা জমি বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার প্রসারণের জন্য দখল করে দিয়েছিলেন বা দান করেছিলেন। পানিহাটির বেঙ্গল কেমিক্যালের সেই কারখানাটিতে তুলো, ব্যান্ডেজ, আলকাতরা থেকে শুরু করে ফিনাইল, পিচ ইত্যাদি তৈরি হত। আচার্যদেব তাঁর ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রবন্ধে আশাব্যঞ্জক ভঙ্গিমায় লিখেছেন,— "পানিহাটির বা পেনেটির কারখানা তৈরি শেষ হলে তা বেঙ্গল কেমিক্যালের মানিকতলার পুরোনো কারখানার চেয়ে অনেক বড় হবে।"

আচার্যদেব তাঁর ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ১৯২৬ সালে (শ্রাবণ,১৩৩৩)। সেই প্রবন্ধে জানা যায় যে, তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ গত শতাব্দীর বিশের দশকের দিকে বেঙ্গল কেমিক্যালে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি যেসব তৈরি হত তার একটা তালিকা নীচে দেওয়া হল। 

রাসায়নিক দ্রব্যঃ- রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া, ফটকিরি, হীরাকষ তৈরি হত।

ওষুধঃ- ওষুধের মধ্যে ডাক্তারি টিংচার আদি তৈরি হত। দেশীয় গাছ-গাছড়া থেকে তৈরি নানা রকমের ওষুধ তো ছিলই। এর পাশাপাশি তখনকার দিনে Tea waste থেকে Caffine (ক্যাফেইন) তৈরি হত।  

বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিঃ- নানাব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরি হত বেঙ্গল কেমিক্যালে যেমন- Fire Extinguishers (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র), Gas Plants(গ্যাস প্ল্যান্ট) এবং আগে উল্লেখিত  Tube wells(টিউব ওয়েল বা নলকূপ)।  

এখানে একটা কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না যে, আচার্যদেবের আমলে এই কারখানার সুপারিনটেন্ডেন্ট শ্রী সতীশচন্দ্র দাসগুপ্ত এই কারখানায় কাজ করার সময় নানান আবিষ্কারের মধ্যে ‘ফায়ার কিং’ নামে একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার দাম অনেক অল্প ছিল এবং কাজেও ভালো ছিল। যার ফলে এই যন্ত্রটি বাজারেও খুবই সমাদৃত ছিল। বিজ্ঞানী সতীশচন্দ্র দাসগুপ্তের কথা আমরা এই প্রবন্ধের চতুর্থ পর্বে আলোচনা করেছি। তা তিনি কোকনদ কংগ্রেসে শিল্পপ্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে মহাত্মা গান্ধীর সাথে পরিচয়লাভ করেছিলেন। গান্ধীজীর নির্দেশে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা্য কর্মীদের দিয়ে চরকায় সুতো কাটানো, তাঁত চালানো ও কাপড়-বোনার কাজ শুরু করেছিলেন। আচার্যদেবও চরকার খুবই প্রশংসা করতেন ও নিজেও চরকা কাটতেন।

যাইহোক, এই তালিকা থেকেই একটা ব্যাপার পরিস্কার যে, বেঙ্গল কেমিক্যাল বর্তমানের চেয়ে আচার্যদেবের আমলে অনেকটাই সমৃদ্ধশালী ছিল।

No comments