Header Ads

হারিয়ে যাওয়া তানসেনের তানপুরার রহস্যভেদ করবে কে? তাই নিয়ে জমে উঠেছে 'তানসেনের তানপুরা'


ইতিহাস বইয়ের পাতায় মোগল সাম্রাজ্যের কথা পড়তে গেলে সবার প্রথমে আকবরের নাম ভেসে আসে। তাঁর রাজ দরবারে ছিলেন নবরত্ন। এই নবরত্নের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন মিঞা তানসেন। যিনি সঙ্গীত সম্রাট নামে পরিচিত। আকবরের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। মধ্য-পশ্চিম ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তানসেন ছিলেন এক অতুলনীয় মহারথী। যার মধ্যে ছিল এক অসীম ক্ষমতা। তিনি দীপক রাগে বহ্নিশিখা সৃষ্টি করে মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি আনতে ভুলতেন না। কথিত আছে,  সঙ্গীত দিয়ে তিনি নাকি বৃক্ষ ও পাথরকে আন্দোলিত করতেন। তাঁর কাছে সঙ্গীত ছিল শক্তির উৎস। তিনি যে তানপুরা বাজাতেন সেই তানপুরা তুলে দিলেন তাঁর প্রিয়তম শিষ্যের হাতে।  তারপর শিষ্য পরম্পরায় এই তানপুরা রহস্যময় হয়ে থেকে গেছে। কার কাছে আছে এই তানপুরা? এই রহস্যময় তানপুরার সন্ধান দিলো বাংলার নতুন ওয়েব সিরিজ 'তানসেনের তানপুরা'। সাম্প্রতিক সময়ের যদি সেরা ওয়েব সিরিজ কাউকে বলতে হয় তাহলে আমার মতে সেটা তানসেনের তানপুরা। সদ্য মুক্তি পেয়েছে তানসেনের তানপুরার প্রথম অংশ। মোট পাঁচটি পর্ব আছে প্রথম অংশে। পরবর্তী অংশ মুক্তি পাচ্ছে ৩ রা জুলাই। তার আগে জেনে নেওয়া যাক কেমন হলো তানসেনের তানপুরার প্রথম অংশ। চলুন প্রথমে গল্প ও চিত্রনাট্য নিয়ে আলোকপাত করা যাক ৷ 


গল্পের মুখ্য চরিত্র শ্রুতি এবং আলাপ। দুজনেই কলকাতার বাসিন্দা। তাদের সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকা। শ্রুতি ও আলাপ দুজনেই সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত। আলাপ ভালোবাসেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আর শ্রুতি ভালোবাসেন পশ্চিমী সঙ্গীত৷ শ্রুতির মা যাকে সবাই গুরুমা বলে জানেন। তিনি নিজের মেয়ে শ্রুতিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্রুতি পশ্চিমী সঙ্গীত নিয়েই বেড়ে ওঠেন। শ্রুতির মা মধুবন্তী একজন নামী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী। আলাপের খুব ইচ্ছে শ্রুতির মায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতটা আরো ভালোভাবে শিখে নেওয়া। সেই উদ্দেশ্যেই কলকাতা ছেড়ে আলাপ শ্রুতির সাথে তার দেশের বাড়ি আনন্দধামে রওনা হন। যে গ্রামের আকাশে-বাতাসে মিশে আছে গানের সুর ও রাগ। সেখানে এক সঙ্গীত আসরে শিক্ষাদান রত অবস্থায় শ্রুতির মায়ের সাথে আলাপের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। শ্রুতির মায়ের তালে গলা মিলিয়ে সকলকে চমকে দেন আলাপ। এরপর শ্রুতির মায়ের কাছে গান শেখার জন্য তার কাছে অনুমতি চেয়ে নেন আলাপ৷ গুরুমা রাজী হলেন আলাপকে গান শেখাতে। তারপর কোনো এক ভোরে গুরু-শিষ্য বন্ধনের মাধ্যমে আলাপের নতুন করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখা শুরু হয় ৷


একদিন আলাপ সঙ্গীত শিখতে বসে হঠাৎ তার চোখ আটকে পড়ে সঙ্গীত ঘরের দেওয়ালে টাঙানো একটি পোট্রেটে। তিনি গুরুমাকে জিজ্ঞেস করেন এই ছবিটির বিষয়বস্তু কী? গুরুমা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে আপত্তি জানান। গুরুমা উত্তর দিতে না পারায় ছবির রহস্য ভেদ করতে আলাপ নিজেই শুরু করে দেন। ছবিটি যে কেবল ছবিই তা কিন্তু নয়। এ ছবির মধ্যে লুকিয়ে আছে সঙ্গীতের রাগ। আলাপ ছবিতে হাত দিয়ে একটা কী রকম যেন স্পর্শ অনুভব করেন৷ ছবির পিছন থেকে একটি ছোট্ট রেকর্ডার পান তিনি। যে রেকর্ডারে জানা যায় শ্রুতির দাদু বিভিন্ন রাগের সূত্র দিয়ে গেছেন। যিনি সঠিক রাগের মাধ্যমে এই সূত্রকে ভেদ করতে পারবেন তিনিই পাবেন তানসেনের তানপুরা। এবার এই তানপুরার রহস্য নিয়েই এগোতে থাকে ছবির চিত্রনাট্য। দর্শকদের যাতে আগ্রহের ব্যাঘাত না ঘটে তাই বাকী গল্পের কথা আর বলছি না। 

এই ওয়েব সিরিজের গল্প এককথায় জমজমাট। লেখক সৌগত বসুর হাতের ছোঁয়ায় সৃষ্টি হয়েছে 'তানসেনের তানপুরা'র গল্প ও চিত্রনাট্য। গল্পের সাথে চিত্রনাট্যও একদম নিখুঁত৷ চিত্রনাট্যটি লেখা হয়েছে একদম বাস্তবসম্মত ও তথ্যভিত্তিক। চিত্রনাট্যে গানের রাগ, ধাঁধা, ছবির সূত্র, সাংসারিক টানাপোড়েন, আধুনিক সময়ের ছেলেমেয়েদের অবস্থা ও সেকেলের প্রতিচ্ছবি আরো কত কী চোখের তারায় ধরা দেয়। অত্যন্ত গবেষণা করে চিত্রনাট্যটি রচিত হয়েছে। এমন আকর্ষণীয় চিত্রনাট্যের জন্য লেখক সৌগত বসুকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। কেবল লেখকই নয় বাহবা জানাতে হয় গীতিকার শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়কেও। এই ছবির ক্ষেত্রে গান লেখার কাজটি ছিল যথেষ্টই কঠিন। অন্য ছবির ক্ষেত্রে যেটা হয় গীতিকারকে চিত্রনাট্য বুঝে গান লিখতে হয়, তারপর গান লেখার পর স্বরলিপি তৈরি হয়। কিন্তু এ ছবির ক্ষেত্রে শুধু চিত্রনাট্যই বুঝলেই হবে না, চিত্রনাট্যের সাথে রাগ বুঝে গানটি লিখতে হয়েছে। অনেকটা ঠিক সনেটের মতো। যেখানে শব্দ নির্দিষ্ট তার মধ্যে আপনাকে কবিতা লিখতে হবে। আর এখানে রাগ নির্দিষ্ট তার ওপর লিখতে হবে গানের কথা। শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়ের লেখা গান ছাড়াও আমির খশরু ও রামনিধি গুপ্তের লেখা গানও উঠে এসেছে ছবিতে। 


সিরিজটির গল্প, চিত্রনাট্য নিয়ে কথা হলো, এবার আসি সঙ্গীতের কথায়। সিরিজে ব্যবহৃত হয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত, হোরা, কাওয়ালি, নিধিবাবুর টপ্পা ও পশ্চিমী সঙ্গীতের মতো গান। ছবিতে সঙ্গীত ও আবহসঙ্গীত পরিচালনা করেছেন জয় সরকার। গানের সুর, ছন্দ, তাল অসাধারণ ভাবে তৈরি করেছেন তিনি। গানগুলোতে কণ্ঠ দান করেছেন জীমূত রায়, পিউ মুখার্জী, সোমলতা আচার্য, শুভমিতা বন্দোপাধ্যায়, পণ্ডিত তুষার দত্ত, পণ্ডিত নীহার রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়, অরিজিৎ চক্রবর্তী, অস্মিতা ও অরুণিতা ৷ এই সিরিজের মূল গায়ক জীমূত রায়। যিনি রাগগুলোকে চরিত্রটি অনুযায়ী জীবন্ত করে তুলেছেন। 

গল্প, চিত্রনাট্য, গান নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম। এবার পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয়, সাজসজ্জা ও সম্পাদনা নিয়ে  আলোকপাত করা যাক। 'তানসেনের তানপুরা' পরিচালনা করেছেন পরিচালক সৌমিক চট্টোপাধ্যায়। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে যত্ন সহকারে নিখুঁত ভাবে পরিচালনার দক্ষতা দেখিয়েছেন। সিরিজের সহযোগী পরিচালনায় দেবজ্যোতি ঘোষাল, স্নেহাশিষ সরকার, নবীন কুমার ঘোষ ও শ্যাম্বো মণ্ডল। সিরিজে সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন প্রসেনজিৎ চৌধুরী। ঝকঝকে  দৃশ্যপট, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, লাইটের ব্যবহার ও ড্রোন শট সহযোগে সিনেমাটোগ্রাফি অনবদ্য। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে এমন থ্রিলারধর্মী সিরিজ বাংলা কেন, গোটা ভারতেও নির্মিত হয়নি৷ এই সিরিজের প্রথম অংশের মুখ্য চরিত্র আলাপের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিক্রম চট্টোপাধ্যায় ও শ্রুতির চরিত্রে অভিনয় করেছেন রূপসা চট্টোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্র যেমন মধুবন্তী সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়তী ভাটিয়া, প্রসন্ন বিশ্বাসের চরিত্রে রজত গাঙ্গুলী, বাহাদুরের চরিত্রে দেবেশ রায় চৌধুরী, প্রসন্ন বিশ্বাসের বাড়ির ভৃত্যের ভূমিকায় প্রদীপ ভট্টাচার্য, মধুবন্তীর শৈশবের চরিত্রে অনুরাধা মুখার্জী, রোহিণীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঙ্গনা রায়, ললিত সেনের চরিত্রে সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, তরুণ ললিত সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুহত্র মুখোপাধ্যায়, রঞ্জনের চরিত্রে গৌতম সিদ্ধার্থ ঘোষ, একটি বিশেষ চরিত্রে প্রদীপ ধর ও কল্যাণ চ্যাটার্জী। সকলের সাবলীল অভিনয় যেন প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। 


সিরিজের অভিনয়, চিত্রনাট্য, গান, পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে কস্টিউমস, সাজসজ্জা ও সৃজনশীলতা। যিনি কস্টিউমস, সাজসজ্জা ও আর্ট পরিচালনা করেছেন তাদের প্রশংসা না করে থাকা যায় না। আধুনিক পোশাক, সাবেকিআনা ও রাজকীয় পোশাকের ব্যবহারে চরিত্রগুলো আরো বেশি উজ্জ্বল। এই সুন্দর কস্টিউমসগুলো ডিজাইন করেছেন জয়ন্তী সেন। আর্ট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আনন্দ আঢ্য। তার সহযোগী আর্ট পরিচালনায় ছিলেন সুশোভন সাহু ও শেখর চৌধুরী। সিরিজে ব্যবহার করা হয়েছে আভিজাত্যপূর্ণ সাজসজ্জা। বাড়ির ঝাড়বাতি থেকে চৌকাঠ, চেয়ার-টেবিল, ঠাকুর দালান, সঙ্গীত ঘর, বাদ্যযন্ত্রের ঘর, দেওয়ালে টাঙানো পোট্রেট সবই নজরকাড়া। পর্দায় আমরা যে ছবিগুলো দেখতে পাই তা একদম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এই সিরিজের ভিএফএক্সও উন্নতমানের। 

ছবির প্রতিটি দিক নিয়ে তো বলা হলো। সবশেষে যেটা না বললে প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় তা হলো 'তানসেনের তানপুরা' ছবিতে নতুন কী কী বিষয় উঠে এসেছে? এই সিরিজ রূপে-গুণে সমৃদ্ধ। একদিকে যেমন বিনোদনমূলক অন্যদিকে সিরিজটি  শিক্ষণীয়ও বটে। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাথে মানুষকে পরিচয় করানো, রাগের সাথে আলাপ করানো, ইতিহাস, সাবেকি গানের গুরুদেব রীতিনীতি, আচার-আচরণ, পরিবারিক প্রতিহিংসা ও আধুনিক সমাজের কিছু চেনা ছবি প্রভৃতি বিষয়গুলো যথেষ্ট  শিক্ষণীয়। অন্য ছবিতে ধাঁধার সূত্র যেমন গতানুগতিক দেখে এসেছি সেই ধারাকে ভাঙা হয়েছে এই ছবিতে। রাগ ও পোট্রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বানানো হয়েছে ধাঁধা। সিরিজের জায়গা নির্বাচন অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এমনকি এ সিরিজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাও প্রতিফলিত হয়েছে। সরস্বতী মন্দিরের পাশে আমির খশরুর কাওয়ালি গান, এই ব্যাপারটার ভাবনা অতুলনীয়। পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মিশ্রণে এমন মিউজিক্যাল থ্রিলার যারা এখনও দেখেননি তারা আজই দেখে ফেলুন 'তানসেনের তানপুরা'।

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments