Header Ads

এক অপরাজিত সৈনিকের উপাখ্যান


"কে গো, কে গো, দয়াময়ী। আসিলে হোথায়? বন্দী শুধায়; দেবী শুধু কয়, আজি মধ্য প্রাতে হয়েছে সময় এসেছি মৃত্যু বরিতে তোমায়।" অগ্নিযুগের বিপ্লবী গনেশ ঘোষ মৃত্যুকে এই চোখেই দেখেছেন। জীবন তো কেবল একটা অভিনয়। আর জীবনের সবচেয়ে চিরসত্য হলো মৃত্যু। অতএব জন্মালে সকলকে মরতেই হবে। তবুও আমাদের একটা জীবনে বেঁচে থাকার গুরুত্বই আলাদা। এই একটি জীবনকে সঙ্গে নিয়ে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া মোটেও সহজ নয়। মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। মানুষের জীবনযাত্রা আর অন্য প্রাণীর মতো নয়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ নানা শৃঙ্খলের বাঁধনে আবদ্ধ। অথচ লাখে লাখে মানুষ সামাজিক শৃঙ্খল ভেঙ্গে অন্ধ রাজনীতি, দেশ দখলের লড়াই, খুনোখুনিতে মত্ত হয়ে সভ্যতাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে৷ সেইজন্য এ দেশ, এ রাজ্যের স্বার্থে কত মানুষকে লড়াই করতে হয়। তিনি এমন একটি সময়ে জন্ম নেন যখন দেশের মধ্যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির কাছে দেশবাসী পরাধীন। ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচারে ঝরে পড়ছে কত প্রাণ৷ 


মানুষকে বাধ্য হয়ে বিপ্লব, আন্দোলন ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। ঠিক সেভাবেই গনেশ ঘোষও বাধ্য হয়েছিলেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে গা ভাসিয়ে দিতে। এ রাষ্ট্র হলো আমাদের মা৷ আমরা সকলে মায়ের সন্তান। মা যখন আশ্রয় দিয়েছেন আমাদের তখন সেই মায়ের কোল রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। একজন সন্তানের কর্তব্য তার মায়ের সব দায়িত্ব নেওয়া৷ পরাধীন দেশে  বৈদেশিক শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলা মায়ের সন্তানেরা এক এক করে ফাঁসিকাঠে প্রাণ বিসর্জন দিতে ব্যস্ত৷ বাংলা মায়ের মাটিতে মানুষের ওপর অত্যাচার। দেশের মানুষকে সবরকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিপ্লবী গনেশ ঘোষ পারেননি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে। 

মাস্টারদা সূর্য সেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি স্বদেশি কর্মকাণ্ড শুরু করেন। তাঁর পিতার কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম। সেই সূত্রে তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এই স্কুলে তাঁর বন্ধু অনন্ত সিংহের মাধ্যমে তিনি সূর্য সেনের সংস্পর্শে আসেন৷ সূর্য সেনের অনুপ্রেরণায় তিনি বিপ্লবী দলে যোগ দেন। তিনি অসহযোগী আন্দোলনে অংশ নিয়ে স্কুল-কলেজ, চট্টগ্রামের বার্মা ওয়েল মিল, স্টিমার কোম্পানি, আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ইত্যাদি ধর্মঘটে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন৷ ১৯২২ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে বোমা বানানোর অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন৷ কিন্তু সঠিক প্রমাণের অভাবে তিনি মুক্ত হন৷ এরপর ১৯২৪ সালে ভারতরক্ষা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় চার বছর কারাগারে কাটাতে হয় তাঁকে। 

তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভের পর অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বিপ্লবীদের সাংগঠনিক শক্তির মতাদর্শিক পার্থক্যের জন্য চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে 'অনুশীলন সমিতি'তে যুক্ত হন। এর কয়েক দিন পর সূর্যসেন ও অন্যান্য নেতৃত্ববৃন্দ 'যুগান্তর' দল গঠন করেন৷ এই বিপ্লবী দলের সভাপতি হন সূর্য সেন, সহ-সভাপতি হন অম্বিকা চক্রবর্তী, শহর সংগঠক হন গনেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহ এবং গ্রাম সংগঠকের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্মল সেনকে। পরে এই দলে যুক্ত করা হয় লোকনাথ বলকে৷ 

১৯২৮ সালে মাস্টারদার নেতৃত্বে বহু বিপ্লবী কলকাতা কংগ্রেসে যোগদান করেন৷ এর এক বছর পর ১৯২৯ সালে মাস্টারদা 'বিপ্লবী পরিষদ' গঠন করেন৷ মাস্টারদা, গনেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন ও অনন্ত সিংহ ছিলেন এ পরিষদের পাঁচ সদস্য। পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলের নাম পরিবর্তন করে 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি' রাখা হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ ই এপ্রিল এই পরিষদের সহায়তায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অভিযান সংঘটিত হয়। বিপ্লবী গনেশ ঘোষ এই অভিযানে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে চিহ্নিত হন৷ অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর গনেশ ঘোষ সহ কয়েকজন সঙ্গী বাকীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার জন্য তাঁরা কলকাতা পাড়ি দিলেন। কলকাতা যাওয়ার পথে ফেনি রেলস্টেশনে রেল পুলিশের হাতে বন্দী হন তাঁরা। যদিও পুলিশ তাঁদের বেশিক্ষণ  আটকে রাখতে পারেনি৷ তাঁরা কোনোক্রমে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন৷ কলকাতায় ফিরে আসার পর বিপ্লবী গনেশ ঘোষ যুগান্তর দলের সাহায্যে গা ঢাকা দিলেন হুগলির চন্দননগরে৷ 

১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলাতে ধরা পড়লেন তিনি। তাঁকে অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে প্রেরণ করা হলো সবুজদ্বীপ অর্থাৎ আন্দামানে। তাঁকে বন্দী করা হলো আন্দামানের সেই বীভৎস সেলুলার জেলে৷ দীর্ঘ চৌদ্দ বছর কষ্টের সাথে লড়াই করে সেলুলার জেলে জীবন কাটালেন তিনি৷ অবশেষে ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্ত হওয়ার পর বাংলাতে ফিরে আসেন। 

বিপ্লবী জীবন শেষ করে তিনি কমিউনিস্ট দলে নাম লিখিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিলেন। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷ এর ফলে আবারো কারারুদ্ধ হলেন তিনি৷ কারাগার থেকে মুক্ত হলেন তিন বছর পর। কমিউনিস্ট বিভাজনের পর তিনি ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নবগঠিত দলে নতুন করে রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করলেন। ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ পরপর তিনবার বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন৷ ১৯৬৭ সালে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র থেকে তিনি নির্বাচিত হন৷ তাঁর জীবনটা যেন ছিল একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের মতো। বিপ্লবীদের জীবনগুলো আসলেই কিন্তু এক একটা অভিযান।


তথ্যসূত্র- অনুশীলন ব্লগ, সামহোয়্যার ইন ব্লগ, বাঙালীয়ানা ডট কম, বাংলাপিডিয়া  

No comments