বাংলাতে ভিনগ্রহীদের সাথে যিনি প্রথম আলাপ করালেন
আমরা হয়তো সকলেই জানি বাংলায় ভিনগ্রহীদের নিয়ে প্রথম ছোটো গল্প লেখেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সত্যজিৎ রায়েরও বহুকাল আগে ভিনগ্রহীদের নিয়ে গল্প লিখেছিলেন আরেক বাঙালি সাহিত্যিক। যিনি 'শুক্র ভ্রমণ' নামক একটি বই লিখেছিলেন। তাঁর এই বইটি ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসবিদদের জন্য বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারে। এই বইটি প্রকাশের পর থেকেই অধিকতর জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর হাত ধরেই বাংলা ভাষায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বা সায়েন্স ফিকশন লেখা শুরু হয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বসেই তিনি রচনা করে ফেললেন কল্পবিজ্ঞানের গল্প। তাঁকে বলা হয় বাংলা কল্পকাহিনী সাহিত্যের অগ্রদূত। তিনি হলেন জগদানন্দ রায়৷
বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন৷ তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পারেন যে বিজ্ঞানে সম্যক জ্ঞান থাকতে হলে মাতৃভাষাতেই বেশি বেশি করে বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে। বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা যেখানে তাদের বিজ্ঞানের মূল গ্রন্থগুলি ইংরেজিতে লিখেছিলেন, সেখানে জগদানন্দ রায়ের লেখা বইগুলো হয়ে উঠেছিল বাংলা বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম নিদর্শন। জগদীশ চন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাংলাতে কিছু বিজ্ঞানের বিষয় বাংলাতে প্রকাশের উপযোগী না হওয়ার জন্য বিজ্ঞানের মূল গ্রন্থগুলো ইংরেজি ভাষাতে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ জগদানন্দ রায় বিজ্ঞানের এমন কিছু বই লিখে ফেললেন যার অনন্যতা তাঁকে করে তুলেছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জগদানন্দ রায়ের প্রশংসা না করে থাকতে পারলেন না। কবিগুরুর স্বভাবই যে এমন, ভালো কাজ করলে তিনি তাঁর প্রশংসা না করে থাকতে পারেন না। জগদানন্দ রায়ের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন "জ্ঞানের ভোজে এদেশে তিনিই সর্বপ্রথম কাঁচা বয়সের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজ পথ্য পরিবেশন করেছিলেন।"
জগদানন্দ রায় রচনা করেছিলেন একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ৷ সেইসব গ্রন্থের নামও যথেষ্ট তাবড়-তাবড়৷ প্রকৃতি পরিচয়, আচার্য জগদীশ চন্দ্রের আবিষ্কার, বৈজ্ঞানিক, প্রাকৃতিকী, জ্ঞানসোপান, গ্রহণক্ষত্র, বিচিত্র সন্দর্ভ, সাহিত্য সন্দর্ভ, সুকুমার পাঠ, কনক পাঠ, চয়ন, পোকামাকড়, বিজ্ঞানের গল্প, গাছপালা, সাহিত্য সোপান, আদর্শ স্বাস্থ্যপাঠ, আদর্শ কাহিনী, মাছ-ব্যাঙ-সাপ, বাংলার পাখি, শব্দ, পাখি, বিজ্ঞান-প্রবেশ, বিজ্ঞান পরিচয়, আলো, গদ্য ও পদ্য, সাহিত্য সৌরভ, সঞ্চয়ন, বিজ্ঞান প্রকাশ, স্থির বিদ্যুৎ, চুম্বক, তাপ, চল বিদ্যুৎ, পর্যবেক্ষণ শিক্ষা ও নক্ষত্র চেনার মতো বহুমূল্যের গ্রন্থাবলির রচয়িতা তিনি৷ বৈজ্ঞানিক সত্যকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার তাগিদে তিনি সহজ সরল ভাষাতে এতগুলো গ্রন্থ সৃষ্টি করেছেন। অনেকের মতে তাঁর লেখার আদল ছিল কিছুটা রামসুন্দর ত্রিবেদীর মতো৷
তাঁর লেখা 'শুক্র ভ্রমণ' গ্রন্থটির বিষয় হলো ভিনগ্রহে মানুষের ভ্রমণকাহিনী। মানুষ ভিন গ্রহে যাতায়াতের মাধ্যমে ইউরেনাস গ্রহে ভিনগ্রহী জীবের সাক্ষাৎ লাভ করে। সেই ভিনগ্রহী জীবের বিবর্তনের সাথে আধুনিক বিবর্তনবাদী তত্ত্বের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়৷ তিনি অদ্ভুতভাবে এই গ্রন্থে জীবের বর্ণনাও দিয়েছেন যেমন তারা খানিকটা আমাদের পূর্বপুরুষ বানরদের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের শরীর কালো পশমে ঢাকা৷ দেহের তুলনায় মাথা অস্বাভাবিক ভাবে মোটা। আঙুলে তাদের লম্বা লম্বা নখ রয়েছে৷ তারা সম্পূর্ণ নগ্ন৷
জগদানন্দ রায় পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন শিক্ষক। প্রথমে গড়াইয়ের মিশনারি স্কুলে ও পরবর্তী কালে কৃষ্ণনগর সেন্ট জর্জ হাইস্কুলে কয়েক দিন শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষকতার সাথে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লিখতেন৷ একবার 'সাধনা' পত্রিকায় জগদানন্দ রায়ের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়৷ 'সাধনা' পত্রিকার সূত্র ধরেই এই পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর আলাপ ঘটে৷ রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি শিলাইদহের তাঁর প্রতিষ্ঠিত জমিদারিতে সেরেস্তার কাজ শুরু করেন৷ পরবর্তী সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের গণিত ও বিজ্ঞান শেখানোর জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন৷ রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য-বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন৷ শিক্ষকতা ছাড়াও বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগেও তিনি কাজ করেছেন। তিনি স্ব-কৃতিত্বের জন্য 'রায় সাহেব' উপাধি লাভ করেন৷
নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে তিনি বিজ্ঞান শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন৷ বিধুশেখর শাস্ত্রীর সাথে তিনি 'শান্তিনিকেতন' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এমনকি 'বার্ষিক শিশুসাথী' পত্রিকারও তিনি সম্পাদক ছিলেন৷
কৃষ্ণনগরের অচেনা পল্লীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। বিজ্ঞান নিয়ে লোকটা সারাজীবন ধরে অনায়াসে লিখে গেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময়টাতে প্রেমের কবিতা লিখতে ব্যস্ত সেখানে জগদানন্দ রায় লিখছেন কল্পবিজ্ঞান। এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা। জগদানন্দ রায়ের প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে তাঁর লেখনীতে৷ তাঁর গ্রন্থের ভিত্তিতে তিনি একজন সুদুরপ্রসারি বৈজ্ঞানিক৷ তিনি বিজ্ঞান চেতনায় বহু যুগ এগিয়ে আছেন। আজকে জগদানন্দ রায় নামটা হয়তো অনেকের কাছেই অচেনা। কিন্তু তিনিই হলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অগ্রদূত।
তথ্যসূত্র- অনুশীলন ব্লগ, উইকিপিডিয়া, নিউজএসজি ২৪
Post a Comment