বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ
"এনেছিলে সঙ্গে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান"। দেশবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর উদ্দেশ্যে কবিগুরু লিখলেন এই কবিতা। ১৯২০ এর দশকে বাংলাতে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক ধারার উদ্ভব হয়েছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের হাত ধরে। বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে উঠে এসেছিল তাঁর নাম। বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার হবার পরও রাজনীতির ভাষা হিসেবে ইংরেজির জায়গায় বাংলাকে স্থান করে দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে বাংলার রাজনীতিতে সেই সময় এক নতুন প্রাদেশিক আবেগের জোয়ার দেখা দিয়েছিল৷ তিনি বাংলার হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা করতেন। হিন্দু-মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি বেঙ্গল প্যাক্ট নামে একটি চুক্তি সম্পাদনা করেছিলেন। এই চুক্তিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ৷
বেঙ্গল প্যাক্টের চুক্তিপত্রে ছটি ধারার কথা বলা হয়। সেগুলি হলো (১) বঙ্গীয় আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মণ্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে৷ (২) স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ। (৩) সরকারি চাকরির পঞ্চান্ন শতাংশ পদ পাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। যতদিন না অনুপাত পঞ্চান্ন শতাংশে পৌঁছানো যাবে ততদিন মুসলিমরা পাবে আশি শতাংশ আর হিন্দুরা পাবে কুড়ি শতাংশ। সরকারি চাকরি ছাড়াও কলকাতা কর্পোরেশন, জেলা ও স্থানীয় বোর্ড তথা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলিমরা ঐ হারে চাকরি পাবে। (৪) কোনো সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো আইন ঐ সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পচাত্তর শতাংশের সম্মতি ছাড়া উপস্থাপন করা যাবে না। (৫) মসজিদের সামনে বাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না। (৬) খাদ্যের জন্য গরু জবাই নিয়ে আইন সভায় কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। আইন সভার বাইরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। গরু জবাই করার সময় যাতে তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত না করে তার দিক নজর রাখতে হবে। ধর্মীয় কারণে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
বেঙ্গল প্যাক্টের বিরোধিতা করেছেন বহু রাজনৈতিক নেতা। কেউ কেউ মুসলিমদের সুবিধা প্রদানকারী চুক্তি বলেও বিরোধিতা করেছেন বেঙ্গল প্যাক্টের৷ হাজার বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও তিনি নিজের স্থান থেকে একচুলও নড়লেন না। তিনি চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন। তিনি এই চুক্তির প্রসঙ্গে সেকেলের পত্রিকাগুলোকে বলেছিলেন "হিন্দুর যদি মুসলমানের মনে আস্থা সৃষ্টি করিতে না পারে, তবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য আসিবে না। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ব্যতীত আমাদের স্বরাজের দাবি চিরকাল কল্পনার বস্তুই থাকিয়া যাবে।" তাঁর বেঙ্গল প্যাক্টকে সমর্থন করতেন সুভাষচন্দ্র বসু, অনিলবরণ রায়, কিরণশংকর রায়, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও প্রতাপচন্দ্র গুহের মতো মহান ব্যক্তিত্বরা৷
বেশ কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চিত্তরঞ্জন দাশের বিরোধিতা শুরু করেন। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের সকল মানুষ চিত্তরঞ্জন দাশকে সমর্থন জানাতে থাকেন৷ স্বরাজ্য দলের প্রাথী হিসেবে তিনি মুসলিমদের অধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। মুসলিম সমাজও তাঁর ভরসার মর্যাদা দেয় ভোটের বাক্সে। ব্রিটিশ গভর্নর লিটনের বিশ্বঘাতকতার বিরুদ্ধেও জবাব দেন তিনি। লিটনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বুদ্ধিমত্তার সাথে চিত্তরঞ্জন দাশ নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় স্বরাজ্য দল অভিনব এক প্রস্তাব আনে। মন্ত্রীদের মাইনে কমিয়ে বছরে এক টাকা নির্ধারণ করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল ৬২ থেকে ৬৩ টি ভোটেও স্বরাজ্য দলের প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়৷ পরবর্তী কালে আরো যে একটি নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে স্বরাজ্য দলের ভোট বেড়ে হয় ৬৮। এরপর মন্ত্রীরা একে একে পদত্যাগ শুরু করেন। আইনসভা অচল হয়ে পড়ে, স্বরাজ্য দলের স্বপ্নপূরণ হয়৷ দেশবন্ধুর স্বপ্ন সফল হয়। তবে বেঙ্গল প্যাক্ট বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯২৫ সালের ১৬ ই জুন তাঁর মৃত্যুর পর ব্যর্থ হয়ে যায় বেঙ্গল প্যাক্ট।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বা সি.আর দাশ ১৮৭০ সালের ৫ ই নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের টংগিবাড়ী উপজেলার তেলিরবাগ গ্রামের এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ভুবনমোহন দাশ ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের সলিসিটার। চিত্তরঞ্জন দাশের প্রাথমিক জীবন শুরু হয় কলকাতার ভবানীপুরের লন্ডন মিশনারী স্কুলে। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে৷ এই কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে ইনার টেম্পলে যোগদান করে ব্যারিস্টার হন৷ লন্ডনে ব্যারিস্টার হবার পর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন বাংলাতে। তারপর কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার হিসেবে নিযুক্ত হন৷
কলকাতায় যখন এক মণ চালের দাম আড়াই টাকা ছিল, তখন চিত্তরঞ্জন দাশ এক একটা মামলাতে এক হাজার টাকা পারিশ্রমিক নিতেন। যদিও সবক্ষেত্র তিনি পারিশ্রমিক নিতেন না৷ প্রথম জীবনে তিনি বিলাস ও ব্যয়বহুল জীবনযাপন করতেন। তাঁর পোশাকেও ছিল আভিজাত্যের ছাপ। সূদুর প্যারিস থেকে তাঁর পরিধেয় বস্ত্র ধোলাই করে নিয়ে আনা হতো। যদিও রাজনীতিতে আসার পর তিনি বিলাসিতা ত্যাগ করেছিলেন৷ তিনি কেবল আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিই ছিলেন না, তিনি সাহিত্যচর্চা করে হয়ে ওঠেন একজন সফল কবি ও লেখকও। বিভিন্ন মননশীল রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও বক্তৃতা রচনার পাশাপাশি গল্প, কবিতা ও কাব্য সমালোচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি রচনা করে গেছেন সাগরসঙ্গীত, অন্তর্যামী, কিশোর-কিশোরী, কাব্যের কথা, বাংলা গীতি কবিতার মতো অসংখ্য গ্রন্থ এবং বঙ্কিম প্রতিভা, বাংলার কথা, বাঙালির বঙ্কিমচন্দ্র, স্বরাজ সাধনার মতো বেশ কিছু প্রবন্ধ। এর পাশাপাশি তিনি শ্লোক ও স্তোত্র গীত রচনা করতেন, যা প্রতিদিন সকালে তিনি গাইতেন। 'ব্রাক্ষ্ম জনমত' এর সম্পাদক হওয়ার কলকাতার সাংবাদিকতা জগতে বেশ পরিচিত ছিলেন।
উচ্চ সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি ছিলেন একজন দানবীরও৷ তিনি যেমন রাজনীতিতে সচেতন ছিলেন তেমন ছিলেন দাতা স্বভাবের। দু'হাত ভরে তিনি দান করে গেছেন এই বাংলার স্বার্থে৷ তিনি সর্বদা জনকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন৷ স্বরাজ্য পার্টির প্রতিষ্ঠা করে লাখ লাখ টাকা সেখানে খরচ করেন। ফলে তিনি একসময় দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন৷ দেউলিয়া হওয়ার পরও তিনি এতটুকুও ভেঙ্গে পড়েননি। বাংলা ও বাঙালির স্বার্থে অভাবের জীবনকেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন৷ ফৌজদারির কাজের জন্য নিজের খরচ বাঁচিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে ভবানীপুরে যেতেন৷ ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলাতে অভিযুক্ত সংগ্রামী অরবিন্দ ঘোষের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয় চিত্তরঞ্জন দাশকে। তিনি অরবিন্দ ঘোষের বিচারের জন্য একটা টাকাও নেননি। ১৯০৮ সালে অরবিন্দ ঘোষের বিচার তাকে পেশাগত মঞ্চের সম্মুখ সারিতে নিয়ে আসে৷ তিনি নিজ সনিপুণ দক্ষতার সাথে মামলাটিতে বিবাদী পক্ষ সমর্থন করেন যে অরবিন্দ ঘোষকে শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ দেশের জন্য ত্যাগ করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদার বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তিনি উদার দেশপ্রেম ও বিশ্ব রাজনীতির পথ দেখিয়েছিলেন৷ তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা, ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের ফলে তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরু। বর্তমান যুগে বাঙালির কাছে চিত্তরঞ্জন দাশ খুবই প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের নেশন-বিরোধী বক্তৃতার বয়ান পড়ে চিত্তরঞ্জন দাশ বিচলিত হয়েছিলেন। কবিগুরুর নেশন-চিন্তার মর্মও তিনি খানিকটা উপলব্ধি করেছিলেন৷ তিনি স্বীকার করেন যে "জাতীয়তাবাদকে চরমে নিয়ে গেলে যে বাড়াবাড়ি ঘটে, তারই পরিণাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ৷" তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে হবে। আবার এও মনে করতেন যে "বিশ্বমানবতার এমন একটা যুগ আসবে যখন বিশ্বমণ্ডলের জন্য রাজা রাজড়াদের মতন নেশন ও জাতীয়তারও আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না৷" আজকে বাঙালি সমাজ যেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা ভুলতে বসেছে, সেখানে এতো বছর আগে চিত্তরঞ্জন দাশ বুঝতে পারেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শব্দটার সাথে তিনিই সমগ্র বাঙালি জাতিকে পরিচয় করিয়েছিলেন। আজকে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে যখন বাংলা ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, তখন চিত্তরঞ্জন দাশের আদর্শ সামনে রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালিকে হতে হবে এক মূল্যবান ভোটব্যাঙ্ক ৷
তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, প্রতাপচন্দ্রের স্মৃতিকথা, দৈনিক ইত্তেফাক
Post a Comment