Header Ads

এক বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার পথপ্রদর্শকের কথা


আমরা এই প্রতিবেদনে এমন একজন বাংলার কৃতি সন্তানের সম্পর্কে জানবো যিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞান লেখক, বিজ্ঞান অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, কৃষি গবেষক, স্বদেশী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতা ইত্যাদি। অর্থাৎ একাধিক গুণ সম্পন্ন একজন মানুষ। তাঁর নাম গিরিশচন্দ্র বসু। তিনি জন্মেছিলেন ২৯শে অক্টোবর,১৮৫৩ সালে এবং তাঁর জন্মস্থান বর্ধমান জেলার বেরুগ্রাম। তাঁর পিতার নাম ছিল জানকীপ্রসাদ বসু।


প্রথমেই জেনে নিই, তাঁর শিক্ষাজীবন সম্পর্কে। তিনি ১৮৭০ সালে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৭৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বি.এ. উত্তীর্ণ হন হুগলি কলেজ থেকে। ওই বছরেই তিনি কটকের  রেভেন্‌শ কলেজে প্রভাষক বা লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৮৭৮ সালে তিনি যখন রেভেন্স কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিষয় অধ্যাপনা করতেন তখনি এম.এ. পাস করেন। ১৮৮১ সালে তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করে ব্রিটেনের লন্ডনে যান কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্যে পড়াশোনা করতে এবং ১৮৮২ সালে সেখানকার রয়্যাল অ্যাগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে ডিপ্লোমা পাশ করেন। এর সাথে তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ হিসেবে সেই প্রতিষ্ঠানের আজীবন সদস্যপদ লাভ করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৩ সালে তিনি কেমিক্যাল সোসাইটি অব ইংল্যান্ডের ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ১৮৮৪ সালে তাঁর শেষ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। বিলেতের অধ্যয়ন শেষ করে স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি ঘুরে ১৮৮৪ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। ওই সময়টায় তিনি নিত্যনতুন শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন। তখনকার অনেকের মতো তিনিও ইংল্যান্ডের জীবনযাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভালোবেসেছিলেন টেনিসনের রচনাকে। 

সরকারি অফিসের উচ্চপদ ও সম্মান লাভ করার লোভকে তিনি উপেক্ষা করেছিলেন হয়তো তাঁর স্বদেশী মনোভাবের জন্যে বা বিদশি সরকারের অধীনে না কাজ করার মানসিকতার জন্যে। তাই, সরকারি চাকরির বদলে দেশের কৃষি ব্যবস্থার দেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির কাজে ব্রতী হন। কৃষি কাজে ও ফলনের উন্নতি লাভ করা নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের জন্যে ১৮৮৫ সালে বাংলা ও ইংরেজিতে ‘কৃষি গেজেট’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করতে থাকেন। ইংরেজিতে এই পত্রিকার নাম ছিল ‘Agricultural Gazette’। এটি ভারতবর্ষে প্রথম কৃষিবিষয়ক পত্রিকা। দেশের কৃষিব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যেও কৃষিশিক্ষার প্রচার করা ছিল এই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য। এরপর,শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৮৮৬ সালে ‘বঙ্গবাসী স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বঙ্গবাসী কলেজ’। বিদ্যালয়টিকেই কলেজে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এই কলেজের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার ছাত্রসমাজে কৃষিবিদ্যার প্রচার ও প্রসার ঘটানো। গিরিশচন্দ্র বসু সুদীর্ঘকাল অর্থাৎ ১৮৮৭ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৩৫ সালে উকত কলেজের তিনি রেক্টর হিসেবে মনোনীত হন। 

এবার জেনে নিই বিজ্ঞান শিক্ষা বিস্তারের জন্যে গিরিশচন্দ্র বসুর নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে। এর সাথে জেনে নেওয়া যাক শিক্ষা জগতে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা। এর আগে কৃষি বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের কথা তো বললাম। এবার স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তার সূচনা লগ্ন থেকেই তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে থাকেন। বঙ্গবাসী স্কুলে হাতে-কলমে প্রাথমিক কৃষিবিদ্যা শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তিনি ১৯৩৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজে  জীববিদ্যা বিভাগ খুলেছিলেন। গিরিশচন্দ্র কৃষিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘এ ম্যানুয়েল অব ইন্ডিয়ান বোটানি’, ‘কৃষি সোপান(১৮৮৮)’, ‘কৃষি পরিচয়(১৮৯০)’, ‘কৃষি দর্শন(যার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৭ সালে)’, ‘উদ্ভিদ জনন’, ‘গাছের কথা(১৯১০)’, দুই পর্বে রচিত ‘উদ্ভিদবিজ্ঞান (১৯২৩-১৯২৫)’ ইত্যাদি। শুধু কৃষিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যাই নয় ভূ-বিজ্ঞান নিয়েও বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ বই রচিত হয়েছিল তাঁর কলমে। বইটির নাম ‘ভূ-তত্ত্ব’ যা প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে এবং এটি তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এমনকি, গিরিশ্চন্দ্র বসু ছিলেন বাংলা ভাষায় উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যা বিষয় গ্রন্থ রচনার অন্যতম পথিকৃৎ বা পথপ্রদর্শক। 'এ ম্যানুয়েল অব ইন্ডিয়ান বোটানি’ পাঠ্যপুস্তকে তিনি ভারতীয় গাছ-গাভহালির সাথে ছাত্রদের পরিচয় করিয়েছিলেন। আসলে তৎকালীন ইউরোপীয় পাঠ্যপুস্তকে ভারতীয় গাছেদের কথা পাওয়া যেত না। বিজ্ঞানের বই ছাড়াও তিনি লিখে গেছেন ‘ইউরোপ ভ্রমণ’ ও ‘বিলাতের পত্র’ নামক দুই গ্রন্থ। এই দুই গ্রন্থে তিনি তাঁর ইংল্যান্ডের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন। যাইহোক, আবার ফিরে যাই শিক্ষাজগতে তাঁর অবদানের কথায়৷ ১৯০৪ সালে কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রণয়ন হয়। সেই আইন প্রণয়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ও সিন্ডিকেটের দীর্ঘকালের সদস্য। ১৯১৯ সালে গিরিশচন্দ্র বসু ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’-এর বিজ্ঞান শাখার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ সালে বোটানিক্যাল সোসাইটি অব বেঙ্গলের প্রথম অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

তিনি তৎকালীল বিদেশি সরকারের কাছে কোনোদিনও মাথা নোয়াননি। ব্রিটিশ সরকারের নানা নীতির সমালোচনা করে গেছেন আজীবন। দেশের স্বাধীনতার জন্যেও তিনি কাজ করেছিলেন। তবে, রাজনীতিতে বা স্বদেশী আন্দোলনে তিনি কোনোদিনও জড়াননি। তা সত্বেও, তিনি তাঁর প্রবল স্বদেশপ্রীতির জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। যেসব দেশকর্মী বা বিপ্লবীরা নির্যাতনের শিকার হতেন, তাঁদের শিক্ষাদানের জন্য একসময় বঙ্গবাসী কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন। আসলে, তিনি ছিলেন প্রবল জাতীয়তাবাদী। গিরিশচন্দ্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান হল বি.এ. ক্লাস পর্যন্ত মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। তাই, অনায়াসে বলাই যায় যে, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে গিরিশচন্দ্র বসু একজন সফল ব্যক্তি। 

গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন চেতনার দিক দিয়ে একজন উদার, প্রগতিশীল ও বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি যিনি তৎকালীন সমাজের অস্পৃশ্যতা বা বর্ণপ্রথায় অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বনির্ভরতা লাভ করবে। তিনি কৃষির পাশাপাশি শিল্পের উন্নয়নের কথাও বলতেন। বৈবাহিক সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে ১৮৭৭ সালে তিনি ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। এছাড়াও, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ভূপাল বসু, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, লর্ড এস.পি সিং-সহ ইত্যাদি মনীষীদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এই মহান ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯৩৯ সালের ১লা জানুয়ারিতে। এই ১লা জানুয়ারি শুধু ইংরেজি নববর্ষের জন্য নয় বাংলায় বিজ্ঞান জগতের দুই মহান পথিকৃৎ-এর জন্মদিবস হিসেবেও উল্লেখযোগ্য। এঁরা  হলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও আবদুল্লাহ আল মুতী। এঁদের মতোও তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে মনে-প্রাণে বিশ্বাসী ছিলেন। বিদ্যাসাগরের মতো তিনিও নারীশিক্ষার প্রতি অসীম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং বহুবিবাহের কঠোর বিরোধী ছিলেন। কৃষি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় অবদানের জন্যে তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ঠিকই কিন্তু আমরা বিশেষত বাঙালিরা যখন প্রতিবছর নিউ ইয়ার্স ডে হিসেবে ১লা জানুয়ারিকে সেলিব্রেট করি তখন কি স্মরণ করে রাখি গিরিশচন্দ্র বসু ও বাংলায় বিজ্ঞান ও শিক্ষা জগতে তাঁর অবদানকে? 


তথ্যসূত্রঃ- সংসদ বাঙালি চরিধাভিধান, বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া। 

No comments