বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সাহায্যকারী এক ফরাসী যুবকের রোমাঞ্চকর গল্প
৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১, ওরলি বিমানবন্দর প্যারিস, পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পি.আই.এ এর একটা বোয়িং সেভেন টুয়েন্টি বিমান ওড়বার জন্য তৈরী, যাত্রাপথ রোম হয়ে করাচী। হঠাৎই 'আমার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে, বোমাও আছে,কথা না শুনলে বিমান উড়িয়ে দেব’- ককপিটে ঢুকে চীৎকার করে ওঠে এক ফরাসী যুবক। কি তার কথা ?
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্যে এই বিমানের মাধ্যমে ২০ টন জরুরী ওষুধপত্র সরবরাহ করতে হবে।
দুনিয়ার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় — নিছক মুক্তিপণ নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব বাঙালি উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, অনাহারে রোগে ভুগছিলেন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর তীব্র এক মানসিক তাড়না থেকে তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন।
ওই দিন ফ্রান্স সফরে এসেছিলেন পশ্চিম জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট রাষ্ট্রপতি পম্পেদুর সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্যে। পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের শীতল সম্পর্ক নিরসনের নিরিখে এই সফর ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আর ব্র্যান্ডটের সফরের দিনেই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ফ্রান্সের জন্যে হয়ে দাঁড়ায় একটি স্পর্শকাতর বিষয়।
‘আমার কথা না শুনলে বিমান উড়িয়ে দেব’ — এটা যে কথার কথা ছিল না, তা বিমানের যাত্রীদের বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল না। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছিল বোমার সঙ্গে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার। বিমানে তখন ছিলেন ১২৮ জন যাত্রী। প্যারিসের বিমানবন্দরে ঘটনার শুরু স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে। বিকেল পাঁচটাতে তার দাবি মেনে নেন ফরাসি কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দরে ওষুধের প্রথম চালানটি এসে পৌঁছায়। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম দফায় শিশুসহ আট বিমানযাত্রীকে মুক্তি দেয় ছিনতাই কারী।
তার পরিকল্পনা ছিলো ওষুধপত্র তোলার পর পিআইএ’র এই ফ্লাইটে করেই ভারতে চলে যাবেন। প্রথম দফায় তিনি যেসব যাত্রীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাদের কাছে পৌঁছানোর আগেই তারা রওনা হয়ে যান শহরের দিকে। বিমানের রানওয়েতে তখন অ্যান্টি-এয়ার ইনফেকশন, পাউডার মিল্ক ইত্যাদি অপরিহার্য জিনিসপত্রসহ ওষুধ তোলার কাজ চলছে। তিনি অপেক্ষা করছেন, কখন আসবে ওষুধপত্রের দ্বিতীয় চালান। রাত ৭টার দিকে মেডিক্যাল সামগ্রী ভর্তি দ্বিতীয় ট্রাকটি এসে পৌঁছে বিমানের কাছে। কিন্তু এই পর্বে ওয়্যরহাউজম্যানদের বেশে আসেন পুলিশ কম্যান্ডোরা। বিমানের ক্রু বা যাত্রীরাও বুঝতে পারেননি, এরা আসলে পুলিশের লোকজন। ধরা পড়ে যায় যুবক,পেনিসিলিন পৌঁছানোর ছলে এক কম্যান্ডো পৌঁছে যায় ককপিটের কাছে। ছিনতাইকারীর অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে মুহূর্তেই পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
তবে যুবক ধরা পড়লেও তার বিমান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য ছুঁয়ে গিয়েছিল ফরাসিদের হৃদয়। ধরা পড়ার পরপরই সাংবাদিকরা অ্যামেনস্টি ইন্টারন্যাশানালের এক কর্মকর্তা’র কাছে মেডিক্যাল সামগ্রীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এসব সামগ্রী মালটা অর্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের জন্যেই নিয়ে যাব, কেননা সেগুলোকে তো সেখানেই পাঠানোর কথা হয়েছে।’
এরই মধ্যে ভারতও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের ডামাডোলে বিমান ছিনতাইয়ের এ ঘটনার গুরুত্ব কমে যায়। তবে এন.বি.সি এবং সি.এন.এন টিভিতে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রচারিত হয়। খবরে জানানো হয়, ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হলেও মেডিক্যাল সামগ্রী বাংলাদেশের জন্যে পাঠানো হবে।
গ্রেফতার করার পর দেখা গেল, তার ব্যাগের মধ্যে বোমা-টোমা কিছু নেই।কিছু এলোমেলো বই, একটি মোটাসোটা বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রনিক রেজর, যার মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ব্যাগের বাইরে একটি বৈদ্যুতিক তার।
বছর আঠাশের এই ফরাসী যুবকের নাম জাঁ কুয়ে , কট্টর এক জাতীয়তাবাদী। একসময়ে নিষিদ্ধ ও.এস.এস এর সদস্য ছিলেন।
বিচারের সময় আদালতে তার পক্ষে এসে হাজির হন ফ্রান্সের অনন্য রাষ্ট্রনায়ক, বিশ্বযুদ্ধ ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের সরাসরি যোদ্ধা, দ্য গলের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, দার্শনিক আঁদ্রে মাল্রো যিনি নিজেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন।মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের কাছে এক চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন।
বিচারে জাঁ কুয়ের ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ততদিনে তার বই ‘উয়েপন ইন দ্য হার্ট’ বাজারে এসে গেছে, তা ছাড়া জেলে বসে তিনি লিখেছিলেন আরেকটি উপন্যাস ‘লেস ফাউস ওয়্যর’। তবে ইতিমধ্যেই তিন বছরের কারাবাস হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৩-এর শেষের দিকেই জাঁ কুয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। বাঙালিরা কি মনে রেখেছে তার এই অনবদ্য অবদানের কথা ?
Post a Comment