অগ্নিযুগের বিস্মৃত দেশপ্রেমিক রামকৃষ্ণ বিশ্বাস
- খবরটা পাকা!একদম পাকা!এই
সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।বিপ্লবীদের উপর যে লোকটা এত অত্যাচার করেছে
তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে।
প্রত্যয়ী শোনায় মাষ্টারদাকে।
- কাজটা আমি করব। বোমা বাঁধতে গিয়ে আগুন লেগে
যাওয়ায় জালালাবাদের পাহাড়ের লড়াইতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি।কিন্তু এবার আমার পালা।
কথাটা যিনি বললেন তিনি বছর
কুড়ির এক যুবক।শক্তসমর্থ চেহারা, উজ্জ্বল দুটি চোখ।দলের
দায়িত্বশীল কর্মী।মাস্টারদার স্নেহভাজন।
মাস্টারদা খুশি হলেন।তাঁর
পাশাপাশি দায়িত্ব দিলেন আরেক যুবককে।হত্যার পুরো ছক কষে ফেললেন মাস্টারদা।পুঙ্খানুপুঙ্খ
ভাবে বুঝিয়ে দিলেন তাদের।ধমনীতে উত্তেজনার স্রোত টের পান দুই যুবক।মাস্টারদার
সন্মান তাদের যে রাখতেই হবে।
কিন্তু খবরটা কি?
টি জে ক্রেগ।বাংলার
ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত।চট্টগ্রাম সফরে আসছেন।ট্রেনে
নামবেন চাঁদপুর।ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং দুর্দমনীয় সাহস ছিল ক্রেগের।বিপ্লবীদের প্রতি
বরাবরই ক্রেগ ছিলেন খড়গহস্ত।ক্রমেই বিপ্লবীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন চক্ষুশূল।তাই
প্রত্যাঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী।
গভীর রাতে ট্রেনে চাপলেন
দুই যুবক।গন্তব্য চাঁদপুর।পৌঁছালেন পরেরদিন ভোরবেলা।
১৯৩০ সালের ১লা ডিসেম্বর।কনকনে
শীত।সবে আলো ফুটেছে ভোরের।রাতের গন্ধ এখনও মুছে যায়নি পুরো।চারদিকে একবার তাকায়
দুই যুবক।প্রচন্ড কুয়াশা।দুহাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।প্ল্যাটফর্মে ওত পেতে
বসে রইলেন দুই যুবক।ক্রেগ ট্রেন থেকে নামলেই হবে প্রত্যাঘাত।
কিছুক্ষণ পরেই অপেক্ষার
অবসান।২ নম্বর ডাউন সুর্মা মেইল ইন করলো চাঁদপুরে।দামাল দুই যুবক ছুটলেন প্রথম
শ্রেণীর কামরার দিকে।এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
সশস্ত্র দুই যুবককে ট্রেনের
দিকে ছুটতে দেখেই ক্রেগ বুঝে যান যে বিপদ আসন্ন। চোখের নিমেষে বাথরুমে ঢুকে ভিতর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন
তিনি।ক্রেগকে অভ্যর্থনা জানাতে সেদিন স্টেশনে এসেছিলেন দীর্ঘকায় এক বাঙালি পুলিশ
অফিসার।চাঁদপুরের রেল পুলিশের ইন্সপেক্টর তারিণী মুখার্জি।খাঁকি উর্দি, গায়ে ওভারকোট। বেশ সাদৃশ্য রয়েছে দুজনের চেহারার।বুঝতে ভুল হল দুই যুবকের।
-কে কে ওখানে? ক্রেগ না? হ্যাঁ তাই তো!
বলে উঠলেন প্রথম জন। সম্মতি দিলেন অপরজন।
সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো
দুজনের অগ্নিবর্ষী রিভলভার।দ্রাম!দ্রাম!দ্রাম!
মরণযন্ত্রনায় বাংলায় চিৎকার
করে উঠলেন তারিণী মুখার্জি!ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে শুরু হল হৈ হৈ চিৎকার।ওই যে ছুটে
পালাচ্ছে!ধর ওদের!
দুই যুবক বুঝলেন ভুল হয়েছে।নিহত
ব্যক্তি ক্রেগ নন!শূন্যে গুলি চালালেন দুই রাউন্ড। প্রাণপণ ছুটলেন দুজন। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলেন স্টেশন থেকে।
মুহূর্তে খবর চলে গেলো
চট্টগ্রাম, লাকসাম, কুমিল্লা আর পার্শ্ববর্তী এলাকায়!কাকপক্ষীও যেন পুলিশের নজর
এড়াতে না পারে।সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই গ্রেফতার করতে হবে!
তৎপরতা ব্যর্থ হল না।পরেরদিন
গ্রেফতার হলেন দুই যুবক।সাথে পাওয়া গেলো তিনটি গুলি ভরা রিভলভার, একটি বোমা, কার্তুজ।তারিণী মুখার্জী
মারা যাওয়ার আগে একটি খবর দিয়ে গিয়েছিলেন।দুই যুবকের একজনের গায়ে ছিল নীল আলোয়ান।এই
নীল আলোয়ানের সূত্র ধরেই গ্রেফতার হন দুই যুবক।
তাদের কুমিল্লা জেলে নিয়ে
আসা হয়।রাতে জিজ্ঞাসাবাদ চলে জেল অফিসে।জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিশ সুপার মিস্টার
সুটান এবং স্বয়ং ক্রেগ।
বাঁচার রাস্তা ছিল না
কোন।মৃত্যুদণ্ড হল এক জনের।বয়স কম থাকার জন্যে দীপান্তর হল আরেকজনের।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য
হয়েছিল ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট।স্থান আলিপুর কেন্দ্রীয় জেলখানা।"ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান"-এর দীর্ঘ
তালিকায় যুক্ত হল তাঁর নাম।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস।জন্ম
চট্টগ্রামের সারোয়াতলীতে।১৯১০ সালের ১৬ জানুয়ারী।বাবা দুর্গাকৃপা বিশ্বাস।নিম্ন
মধ্যবিত্ত পরিবার।কিন্তু রামকৃষ্ণ বরাবরের মেধাবী।
চট্টগ্রামের সরকারি কলেজের
বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসাবে ভর্তি হলেন।থাকতেন পাথরঘাটায় বোনের বাড়িতে।ছোটবেলা
থেকেই বিপ্লব তাঁর রক্তে।মাস্টারদার চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে যোগ দিলেন তাঁর বিপ্লবী
দলে।
১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারী মাস।চট্টগ্রাম
দখলের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে চলেছেন মাস্টারদা আর তাঁর দলের সতীর্থরা।কিন্তু
আবেগের বশে সর্বশক্তিমান ব্রিটিশকে হারানো সম্ভব না।দরকার বোমার।বোমার ক্যাপ
দায়িত্ব পেলেন বিজ্ঞানের ছাত্র রামকৃষ্ণ।বোমা বানানো সহজ কাজ নয়, অনুমানের উপর ভিত্তি করে কাজ চলছিল।তবুও হেরে যাওয়ার যুবক
নয় রামকৃষ্ণ।কলেজ ফাঁকি দিয়ে চলল ক্যাপ বানানোর কাজ।
এমন সময় একদিন ঘটে গেলো
দুর্ঘটনা।পিকরিক অ্যাসিডে তৈরি বোমাটি বর্জ্রের মতো ভয়ংকর শব্দে ফেটে পড়ল।হলঘরে
তখন শুধু ধোঁয়া।রামকৃষ্ণ সাংঘাতিকভাবে আহত হলেন।পুড়ে গেলো মুখ, হাত আর বুক।খবর পেয়ে ছুটে আসলেন গনেশ ঘোষ আর অনন্ত সিংহ।রামকৃষ্ণকে
নিয়ে পাড়ি দিলেন শহরের অন্য প্রান্তে।গোপনেই হল তাঁর চিকিৎসা।
রামকৃষ্ণের ভগ্নীপতি সরকারি
চাকরি করতেন।ঘটনার খবর শুনেই তিনি পুলিশে খবর দিলেন।পুলিশ হন্যে হয়ে খোঁজ করতে
লাগলো রামকৃষ্ণের।চালু হল চিরুনি তল্লাশি।রামকৃষ্ণ আহত অবস্থাতেই পালিয়ে বেড়াতে
লাগলেন।অংশগ্রহণ করতেন পারলেন না জালালাবাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে।সুস্থ হলেন
ডিসেম্বর মাসে।আবার যোগ দিলেন মাস্টারদার দলে।
দলের দায়িত্বশীল কর্মী। মাস্টারদার স্নেহভাজন।
ক্রেগ হত্যার কর্মসূচিতে
রামকৃষ্ণের সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী কালীপদ চক্রবর্তী।বিচারে বয়স কম থাকার জন্যে
কালীপদর দীপান্তর হয়।
কথায় বলে বিপ্লবের মৃত্যু
নেই।রামকৃষ্ণ বিশ্বাস চলে যাওয়ার আগে তাঁর অপূর্ব সাংগঠনিক শক্তির এক উজ্জ্বল
সাক্ষর রেখে গেলেন যা অগ্নিযুগের ইতিহাসে আপন দীপ্তিতে দীপ্যমান।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।মাস্টারদার
মানসকন্যা।
রামকৃষ্ণের বোন অমিতা
পরিচয়ে দিনের পর দিন প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।পুলিশ
ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি।
রামকৃষ্ণের ফাঁসির পর
প্রীতি চট্টগ্রাম ফিরে যান।বুকে দুর্জয় সংকল্প।যে করে হোক মাস্টারদার কাছে পৌঁছাতে
হবে।প্রীতির এবার একটা সুযোগ চাই।বেশিদিন প্রীতিকে অপেক্ষা করতে হয়নি।মাস্টারদার
তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলেন আর বাকিটা অগ্নিযুগের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
প্রীতিলতা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস
সম্পর্কে লিখেছিলেন “তাঁর গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি,
খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদী মন এবং প্রগাঢ়
উপলব্ধিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল।আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশি কর্মতৎপর হয়ে
উঠলাম।আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের
পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। রামকৃষ্ণদার ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকান্ডে
সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।”
অগ্নিযুগের বাংলায় রামকৃষ্ণ
বিশ্বাসের মতো অগণিত দেশপ্রেমিক আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন স্বাধীনতা
সংগ্রামের অভিযাত্রায়, তা যে প্রাপ্য প্রচার এবং
মূল্যায়ণ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিতই থেকেছে ইতিহাসের পাতায়, লেখাই যায় সংশয়হীন।
ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে।
তথ্যসূত্র-উইকিপিডিয়া,
আমি সুভাষ বলছি (শৈলেশ দে)
Post a Comment