বেতার পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ শিশির কুমার মিত্র || দ্বিতীয় পর্ব
১৯০৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এলেন তিনি।জগদীশচন্দ্র
বসুকে কাছ থেকে দেখে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠলেন।১৯১২
সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম-এসসি পাশ করলেন। এবার একটা চাকরি দরকার। বিধবা
মা-কে কিছুটা সাহায্য করা দরকার। হাসপাতালে দিন রাত কাজ করতে করতে মা বড়ই দুর্বল
হয়ে গেছেন।
জগদীশচন্দ্র বসু একদিন তিনি ডেকে পাঠালেন তাঁর সেই ছাত্রকে।
সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। মহা উৎসাহে তিনি কাজ শুরু করলেন
জগদীশচন্দ্রের সাথে।কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল। গবেষণা করার জন্য কোন আলাদা টাকা
দেওয়া হয় না আচার্যকে।তাঁর গবেষণা-সহকারীরা সবাই অবৈতনিক।জগদীশচন্দ্র নিজের টাকা
থেকে মাঝে মাঝে তাঁদের কিছু কিছু দেন।কিন্তু তাঁর সেই ছাত্রের পক্ষে আর অবৈতনিক
কাজ করা সম্ভব নয়।সবেতন চাকরির চেষ্টা করতেই হল।কিছুদিন পর ভাগলপুরের টি-এন-জে
কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে নিয়োগ পেলেন।সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর বাঁকুড়া
খ্রিস্টান কলেজে যোগ দিলেন।মন-প্রাণ দিয়ে ছাত্রদের পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন।বাংলায়
বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে লিখতে শুরু করেন।
এদিকে ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯১৬ সালে বিজ্ঞান কলেজে চালু হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের
স্নাতকোত্তর ক্লাস।উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তরুণ
প্রতিভার সন্ধানে আছেন।১৯১২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের ফার্স্টবয়কে খুঁজে বের করলেন
তিনি।স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছ থেকে ডাক পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার
জন্য।তাঁর বয়স তখন ছাব্বিশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তখন
চাঁদের হাট– সিভি
রামন, দেবেন্দ্রমোহন
বসু, মেঘনাদ
সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ
বসু সবাই এক জায়গায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে একটুও সময় নষ্ট করলেন না
তিনি।সি ভি রামন আলোকবিজ্ঞানের গবেষণায় ক্রমেই খ্যাতি লাভ করছেন তখন।কাজ চলছে
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্সের ল্যাবোরেটরিতে।তিনি
আলোকবিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করলেন রামনের তত্ত্বাবধানে।১৯১৮ সালে ফিলোসফিক্যাল
ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র।১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-এসসি ডিগ্রি লাভ করেন তাঁর “ইন্টারফিয়ারেন্স এন্ড ডিফ্রাকশান অব লাইট” থিসিসের
জন্য।
তিনি যখন রেডিও-ফিজিক্স সম্পর্কিত গবেষণা শুরু করেন, তখনও এই
সংক্রান্ত গবেষণা খুব বেশিদূর এগোয়নি।মাইক্রোওয়েভ সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেছিলেন
জগদীশচন্দ্র বসু, হার্টজ
ও অলিভার লজ।জগদীশচন্দ্র বসু মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশান সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্য
পেয়েছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। মাইক্রোওয়েভের ট্রান্সমিটার ও রিসিভার তৈরি
করে সাফল্যজনক ভাবে তার প্রদর্শন করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু সেসময় বিজ্ঞানীদের
মনে একটা ধারণা ছিল যেহেতু মাইক্রোওয়েভ কিংবা ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কোন তরঙ্গ
আলোর মত সরলরেখায় চলাচল করে–
সেহেতু তাদেরকে কোন ধরণের বক্র-তলে পাঠানো সম্ভব নয়। পৃথিবী যেহেতু গোলাকার– তার
বায়ুমন্ডলও গোলাকার। ফলে বেতার তরঙ্গ কোনদিকে পাঠালে সেটা সরাসরি সোজা চলে যাবে।দিক
পরিবর্তন করে অন্যদিকে তার যাওয়া সম্ভব নয়।এরকম ধারণার কারণে রেডিও-ওয়েভ সংক্রান্ত
গবেষণায় আর তেমন উৎসাহ দেখায়নি কেউ।
১৮৮২ সালে বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কিত ধারণা দেন
স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ব্যালফোর স্টূয়ার্ড। বায়ুমন্ডলের উপরিভাগের এই স্তরের
বাতাসে তড়িৎ-প্রবাহ সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা দেন তিনি। এর কারণ হিসেবে তিনি
পৃথিবীর ক্রম-পরিবর্তনশীল চৌম্বক-ক্ষেত্রের উপস্থিতির কথা বিবেচনায় রাখেন। এই
আয়নোস্ফিয়ার কখনও মানুষের কোন কাজে লাগবে বলে ভাবেননি কেউ।
কিন্তু ১৯০১ সালের ১২ ই ডিসেম্বর কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে
বসে ২৭০০ কিলোমিটার দূরের ইংল্যান্ড থেকে প্রেরিত বেতারবার্তা যখন শুনলেন মার্কনি– সবাই আশ্চর্য
হয়ে গেলেন।বেতার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বায়ুমন্ডলের ‘আয়নোস্ফিয়ার’-এর
কী অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে তা মার্কনি বা আর কেউ তখনও জানতেন না।বিজ্ঞানীরা নতুন করে
ভাবতে বসলেন আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কে।১৯০২ সালে আয়নোস্ফিয়ারের উপস্থিতি ও ভূমিকা
সম্পর্কে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা দিলেন ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইড ও
আমেরিকার আর্থার কেনেলি। তাঁরা ধারণা দিলেন ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার উচ্চতায়
বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ার বিদ্যুৎ-প্রবাহ তৈরিতে সক্ষম।বেতার তরঙ্গ বায়ুমন্ডলের এই
স্তরে আলোর মত প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে।কোথায় কতদূরে যাবে এই তরঙ্গ
তা নির্ভর করে তরঙ্গের শক্তি ও কম্পাঙ্কের ওপর।এই মতবাদ গৃহীত হলো।এই স্তরের নাম
দেয়া হলো কেনেলি-হেভিসাইড স্তর।কিন্তু এই পর্যন্তই।পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত কেউ
কোন পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেখিয়ে বলতে পারলো না ঠিক কীভাবে কাজ করে এই
বিদ্যুৎ-প্রবাহী বায়ুস্তর।
বেতার তরঙ্গ সম্প্রচারে আয়নোস্ফিয়ারের ভূমিকার ব্যাপারটা
পুরোপুরি জানা না গেলেও বেতার সম্প্রচার বসে নেই।ভারতবর্ষে বেতার সম্প্রচার বিষয়ে
উৎসাহিত হলেন তিনি।১৯২৩ সালে ‘ইন্ডিয়ান
স্টেটস অ্যান্ড ইস্টার্ন এজেন্সি’
নামে একটা প্রাইভেট কোম্পানি প্রথম সম্প্রচার ট্রান্সমিটার চালু করে কলকাতায়। ‘রেডিও ক্লাব
অব বেঙ্গল’ নামে
একটা সংগঠন তৈরি হলো।‘রেডিও’ নামে একটা
পত্রিকা বের হতো ওই ক্লাব থেকে।বেতার সম্পর্কিত অনেক তথ্য থাকতো সেই পত্রিকায়।তিনিও
তখন এই ক্লাবের সদস্য।ক্লাবের নিজস্ব সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে এবং
রোজ সন্ধ্যেবেলা এই কেন্দ্র থেকে নানা বিষয় প্রচারিত হত।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের
পরীক্ষাগারে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে সেখান থেকে সম্প্রচার শুরু করে দিলেন।এই
সম্প্রচার কেন্দ্রের নাম ছিল রেডিও টু-সি-জেড(2CZ)। ১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার
আগে পর্যন্ত শুধুমাত্র রেডিও ক্লাব ও তাঁর ট্রান্সমিটার থেকেই নিয়মিত অনুষ্ঠান
প্রচারিত হতো।
Post a Comment