১৯৩১ সালের ৭ ই জুলাই
‘এই নাও’। মা আর বৌদিকে
লেখা চিঠিগুলো সার্জেন্টের হাতে তুলে দিলেন দীনেশ। এটা তুমি অফিসে জমা দিও। এবার আমি প্রস্তুত।
কিছুদূর গিয়েই এক জায়গায়
গোল হয়ে দাঁড়াল রক্ষী বাহিনী। সামনেই
স্নানের জায়গা। বন্দিকে
ফাঁসির আগে স্নান করানো হয়। এটাই নিয়ম।
‘স্নান করতে
হবে বুঝি’।
হাসলেন দীনেশ।
‘কি আশ্চর্য
নতুন পোশাকও আছে দেখছি। ঠিক আছে তুমি
আমার চশমাটা ধর সার্জেন্ট। আমি স্নান সেরে
নিচ্ছি।’
মনের আনন্দে গায়ে জল
ঢালতে ঢালতে দীনেশের কণ্ঠে ধ্বনিত হল - " ও জবাকুসুম
সংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম। ধানতয়ারিং সর্বপাপঘঙ
প্রণতোহস্মি দিবাকারাম। "
অবাক হয়ে যায় শেতাঙ্গ
সার্জেন্ট। বন্দি জীবনে
ফাঁসি বহু দেখেছেন কিন্তু এই ছেলেটি ব্যতিক্রম। এত নির্বিকার সে। শেষ কমাসে তাঁর
ওজন অবধি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বয়সে
মৃত্যুকে জয় করার এমন শক্তি পেলেন কি করে ?
‘তোমার ভয় করে
না ইয়ংম্যান’?
‘ভয় কিসের ভয়’। হেসে উঠলেন
দীনেশ। আমাদের গীতায় কি বলেছে
জানো ?
"বাসাংসি
জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গ্রিনহাতি
নরহপরানি
তথা শরিরানি বিহায়
জীর্ণা
নন্যটি সংযাতি নবানি
দেহি"
অর্থাৎ মানুষ যেমন
জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র ধারণ করে , সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করে অন্য নতুন শরীরে
আসবে।
তাহলে ভয় কিসের। এ দেহ পরিত্যাগ করে অন্য নতুন শরীরে পরিগ্রহ করে। আপনার
সাথে আবার দেখা হবে সার্জেন্ট।
‘আমার সাথে
দেখা হবে? কোথায় দেখা
হবে’?
‘বোধহয় এখানেই। সেইদিনও হয়তো তোমাকেই এই অপ্রিয় কাজটার দায়িত্ব আবার
নিতে হবে।’
এটা বলেই প্রাণখোলা
হাসিতে হেসে উঠলো দীনেশ।
‘যাক আমার হয়ে
গেছে’। স্নান শেষে পোশাক পরিচ্ছদ পরে হাসতে হাসতেই বলে দীনেশ। আমি প্রস্তুত। এবার যাওয়া
যেতে পারে।
ধীর বলিষ্ঠ পদে ফাঁসির
মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ালেন দীনেশ। কোন ভয়, ক্ষোভ , শঙ্কা কিছুই
নেই।
‘তোমার কিছু
বলার আছে বন্দী’ ?
‘প্লিজ স্টপ। আমাদের বলার
অধিকার যারা কেড়ে নিয়েছে, সেকথা তো
তোমরা ভালো করে জানো। তাহলে কি লাভ
এসব মিথ্যা ফর্মালিটি দেখিয়ে। ডু ইওর ডিউটি। আই এম রেডি।’
মুখের উপর জবাব দিয়েই
বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন "বন্দেমাতরম"।
নিমেষে একটা ঝড় বয়ে
গেল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। হাজার হাজার বন্দী
বিপ্লবীদের মুখেও ধ্বনিত হল "বন্দেমাতরম। দীনেশ গুপ্ত জিন্দাবাদ। "সুর মেলাল সাধারণ কয়েদীরাও। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল দূর থেকে দূরান্তরে।
সকলের মুখে একটাই কথা
- দীনেশ গুপ্ত জিন্দাবাদ।
আলিপুর জেলে ১৯৩১-এর
৭ই জুলাই ভোর পৌনে চারটেয় ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন উনিশ বছরের দীনেশ
গুপ্ত।
বন্ধ হয়ে গেল কোর্ট, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, দোকান পাট , যানবাহন।
বিকেলে হাজার হাজার
লোক জমা হল মনুমেন্টের নীচে। সেখানেও সকলের
মুখে একটাই কথা - দীনেশ গুপ্ত জিন্দাবাদ।
পরের দিন সকালে
দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ‘Advance’ কাগজের শিরোনাম,
"Dauntless Dinesh Dies at Dawn!”
একধাপ এগিয়ে গেল মাসিক
"বেণু" পত্রিকা। নিমেষে শেষ
হয়ে গেল হাজার হাজার "দীনেশ সংখ্যা"। কলকাতা কর্পোরেশন সরকারি ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দীনেশ
গুপ্তর স্মৃতির উদ্দেশ্যে পাস করল শোক প্রস্তাব।
দীনেশের ফাঁসির আদেশ
বঙ্গজ বিপ্লবীদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করেছিল। মেদিনীপুরের দীনেশ গুপ্তের
প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরাই ডগলাস, বার্জ এবং
জেমস পেডি - এই তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করে এর বদলা নিয়েছিল।
দীনেশের মৃত্যুদণ্ডের
নেপথ্যে যিনি ছিলেন পুরোধা, সেই রালফ
রেনল্ডস গার্লিক কে অচিরেই প্রাণ দিতে হয়েছিল। জয়নগরের বিপ্লবী কানাইলাল
ভট্টাচার্য ১৯৩১-এর ২৭ শে জুলাই, দীনেশের
ফাঁসির কুড়ি দিনের মধ্যে, ভরা এজলাসে
গুলি করে খুন করেছিলেন গার্লিককে।
তথ্যসূত্র - আমি সুভাষ বলছি
Post a Comment