স্ট্রিং থিওরি এবং এক বাঙালি বিজ্ঞানী
প্রায় একশো বছর আগে আইনস্টাইনের সাধারণ
আপেক্ষিকতাবাদকে যাঁরা এ দেশে সাদরে বরণ করেছিলেন, তাদের পুরোভাগে ছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানীরা। আর সেই আপেক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নিয়ে
যাওয়ার জন্য ভারতে যারা বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন, তাদের মধ্যেও প্রথম সারিতে রয়েছেন এক ঝাঁক উজ্জ্বল বাঙালি ব্যাক্তিত্বই।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ
দ্বন্দ্বের মীমাংসা করার জন্য সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। এই
সমস্যার এক সম্ভাব্য সমাধান হল স্ট্রিং থিওরি। স্ট্রিং থিওরি তত্ত্বে পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান কণার বদলে সুতোর মতো কিছু
একটার অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে যাবতীয় ক্রিয়া এই তত্ত্ব একাই
ব্যাখ্যা করতে চায়। শুধু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম নয়, তাঁর বর্তমান অবস্থাও ব্যাখ্যা করে ‘স্ট্রিং থিওরি’। ব্যাখ্যা করে মহাশূন্যে ব্ল্যাক হোলের নানা লক্ষণ। এমনই একটি তত্ত্বের
সন্ধান আজীবন করে গিয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইন।
আর সেই গবেষণা জগতের অন্যতম পুরোধা হলেন এক
বাঙালি বিজ্ঞানী। গর্বের কথা হল, বহু বিদ্যমান বিজ্ঞানী
ভারতে কাজ করেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছেন। কিন্তু তার ব্যাপারটা ভিন্ন,
তিনি শুধুমাত্র খ্যাতি লাভ করেন নি — তিনি বারংবার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গিয়েছেন, সন্ধান দিয়েছেন নতুন দিশার, হয়েছেন তামাম বিশ্বের
বিজ্ঞানী সমাজের পথপ্রদর্শক।
জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৫ জুলাই কলকাতায়। অনিল কুমার সেন এবং গৌরী সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র
তিনি। অনিল কুমার সেন স্কটিশ চার্চ-এর কলেজের পদার্থবিদ্যার একজন প্রাক্তন
অধ্যাপক। বাবার কাছ থেকেই পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার অনুপ্রেরণা পান। তিনি শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এরপর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫
সালে স্নাতক এবং আইআইটি কানপুর থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। প্রেসিডেন্সি
বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অমল কুমার রায়চৌধুরীর ছাত্র। তাঁর
গবেষণা তাকে অনুপ্রাণিত করে। এরপর স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট লাভ করেন। তারপর
ফিরে আসেন দেশে। মুম্বই-এর টাটা
ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫
সাল পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি এলাহাবাদের হরিশচন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত। তিনি
একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হল
স্ট্রিং থিওরি এবং কৃষ্ণগহ্বর। মহাবিশ্বের গুঢ় থেকে গুঢ়তম রহস্যভেদের নিরলস সাধনে
মগ্ন এই বিজ্ঞানী। তিনি কৃষ্ণগহ্বরের রহস্যভেদের এক অন্যতম পথিকৃৎ। তাত্ত্বিক
পদার্থবিজ্ঞানে সবই খাতাকলমে কাজ, সেনও তাই করেন। তাঁর
বর্তমান গবেষণার মূল বিষয় হল এট্ট্রাক্টর মেকানিসম এবং স্ট্রিং তত্ত্বে কৃষ্ণগহ্বরের
মাইক্রোস্টেটস কাউন্টিং-এর স্পষ্টতা নিয়ে। কাপলিং ডুয়ালিটি (এস ডুয়ালিটি) নিয়ে
তাঁর সারা জাগানো কাজ রয়েছে। স্ট্রিং থিওরি নিয়েও তাঁর অনেক পেপার রয়েছে।
এলাহাবাদনিবাসী এই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ২০১৪ সালে
সম্মানিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডিরাক পদকে। প্রতি বছর ৮ ই আগস্ট,
নোবেলজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাকের
জন্মদিনে তাঁর নামাঙ্কিত এই পদক দেওয়া হয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় অসামান্য
কৃতিত্বের জন্য ১৯৮৫ সাল থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
তিনি এর আগেও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার
পেয়েছেন। ২০১২ সালে পাওয়া ‘ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স
প্রাইজ’ যার অন্যতম। তারও আগে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’ ১৯৮৯ সালে তাঁকে দিয়েছিল ‘আইসিটিপি প্রাইজ’। এখন তিনি ওই সংস্থার ‘সায়েন্টিফিক কাউন্সিল’-এর অন্যতম সদস্য। এছাড়াও তিনি বহু দেশী, বিদেশী পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ভারত সরকার তাকে ২০০১ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০১৩
সালে পদ্মভূষণ সন্মান দিয়েছেন। ১৯৯৮ সালে থেকে তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য। বিশ্ববিখ্যাত
বিজ্ঞানী স্টিফেন্স হকিংস তাঁর নাম এই সম্মানের জন্যে মনোনয়ন করেছিলেন। তিনি শান্তি স্বরূপ ভাটনাগর পুরস্কার পেয়েছেন
১৯৯৪ সালে।
অশোক সেন। সদাহাস্যময়, সদাবিনয়ী, আড়ম্বরহীন ঐ মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি কত বড়মাপের বিজ্ঞানী। গবেষণার
বাইরে উপভোগ করেন ভ্রমণ। ভালোবাসেন ইউরোপের শহরগুলি হেঁটে পরিভ্রমণ করতে। আর পাঁচজন
বাঙালির মতোই তিনি ভোজনরসিক। আর নিজেও অতীব রন্ধনপটু। বেশী পছন্দের মাছমাংস। কনফারেন্সে ডিনারে আমিষ আর স্যালাড
ছাড়া অন্য কিছু পাতেই নেন না।
বিজ্ঞানী অশোক সেন বাংলা ও বাঙালির গর্ব। সম্প্রতি উনি বিশ্বের সেরা ১০০ জন বিজ্ঞানীর
একজন বলে গণ্য হলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়
হলো যে মানুষটি বিশ্বজুড়ে এত খ্যাতি, তাকে বর্তমান
প্রজন্ম চেনে না।
তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া,আনন্দবাজার,বিজ্ঞান ব্লগ
Post a Comment