কৃত্রিম কিডনি বানিয়ে চমক বাঙালি বায়ো-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের
যেন একটা কফির কাপ! আর সেটা দিয়েই কিডনির কাজটা
হয়ে যাবে! আর সেই কফির কাপটাকে বসিয়ে দেওয়া যাবে শরীরের ভেতরেই!
বিগড়ে যাওয়া দু’টি কিডনি বাদ দিতে হলে আর নতুন দু’টি কিডনি পাওয়ার
জন্য হাপিত্যেশ প্রতীক্ষায় বসে থাকতে হবে না। হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না আর।
গত সাত বছরের লাগাতার চেষ্টার পর শেষমেশ কৃত্রিম
কিডনি বানিয়ে ফেললেন এক বাঙালি বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার। সানফ্রান্সিসকোর
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।
ট্যাঙ্কার ফাউন্ডেশনে ওই আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, আর বছর দু’-তিনেকের মধ্যেই আমেরিকার বাজারে বাণিজ্যিক ভাবে
এসে যাবে ওই কৃত্রিম কিডনি। ইউরোপ সহ বিশ্ব বাজারেও সেই কৃত্রিম কিডনি আসতে দেরি
হবে না। তার বানানো কৃত্রিম কিডনি এখন শীর্ষ মার্কিন সংস্থা ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এফডিএ)-এর অনুমোদনের অপেক্ষায়।
তলপেটে যেখানে শরীরের দু’পাশে আমাদের দু’টি কিডনি রয়েছে, সেখানেই যে কোনও এক দিকে ওই কফির কাপের মতো কৃত্রিম কিডনিকে বসিয়ে দেওয়া যাবে।
তাকে চালাবে হার্ট থেকে আসা রক্তই। তবে সেই রক্তকে ফিল্টার করে নেবে ওই কৃত্রিম
কিডনি। নজর রাখবে যাতে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলি শরীরে ঠিক ভাবে তৈরি হয় আর
সংশ্লিষ্ট গ্রন্থিগুলি (গ্ল্যান্ডস) থেকে সেই হরমোনগুলির ক্ষরণ হয় পর্যাপ্ত
পরিমাণে। শুধু তাই নয়, শরীরে রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে
রাখার কাজটাও করবে ওই কৃত্রিম কিডনি।
নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে আর কিডনি প্রতিস্থাপনের
জন্য যে বিপুল খরচ হয়, তা অনেকটাই কমে যাবে
কৃত্রিম কিডনি শরীরে বসানো গেলে।
জীবনের সিংহভাগ বিদেশে কাটলেও শেকড়ের প্রতি,
চট্টগ্রামের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ আজও রয়েছে তার। ডাল-ভাত
তার ভীষণ পছন্দের। ইলিশ ও শুঁটকি তার
কাছে পৃথিবীর সেরা খাবার। আজ গ্রাম রোসাঙ্গগিরি গেলে আর ফিরতে ইচ্ছা করে না তার। ছোটবেলায় বহুবার গিয়েছেন। বর্তমানে কাজের চাপে সেই সুযোগ কমই আসে। আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল মা-বাবার সঙ্গে
বোয়ালখালী গেলে করলডেঙ্গা পাহাড় চষে বেড়ানোর কথা, কর্ণফুলীতে নৌকায় চড়ে হারিয়ে যাওয়ার কথা। খুব মনে পড়ে তার চট্টগ্রামকে। রবীন্দ্রসংগীত খুব পছন্দের।
নতুন কিছু তৈরির ব্যাপারে তার আগ্রহ ছোটবেলা
থেকেই। পরবর্তীকালেও ভিন্ন কিছু
করতে চেয়েছেন, তাই প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়ন করেছেন। বিশ্বে প্রথম
কৃত্রিম কিডনি আবিষ্কার করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন তিনি। নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে সারা বিশ্ব জুড়ে ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দেন তিনি। এর
পাশাপাশি তিনি সূক্ষ্ম ওয়্যারলেস সেন্সর উন্নয়নের কাজ করেছেন। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন
রোগীর জন্য এমন চিপস তৈরি করেছেন, যা শরীরে প্রতিস্থাপন করলে
কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না।
শুভ রায়। জন্ম ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির
রোসাঙ্গগিরিতে। তার বাবা চিকিৎসক অশোক নাথ রায় চট্টগ্রামের আশকারদীঘির উত্তর পাড়ের
মাউন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। দাদা নগেন দে বোয়ালখালীর স্যার
কানুনগোপাড়া আশুতোষ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। শুভ রায়ের মা রত্না রায়ের বাড়ি
চট্টগ্রাম শহরের আলকরণে।
পাঁচ বছর বয়সে ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীর একটি
বিদ্যালয়ে নার্সারিতে শুভ রায়কে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর পেশাগত কারণে
১৯৭৪ সালে তাঁদের উগান্ডায় চলে যেতে হয়। সেখানে স্বামী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।
শুভ রায়ের শিক্ষাজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে উগান্ডা ও আমেরিকায়। উগান্ডার জিনজা
সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে সেকেন্ডারি পাস করেছেন শুভ রায়। সেই স্কুলে পড়াতেন
তাঁর মা-ও। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান শুভ। বাড়ির অন্য সকলে ডাক্তার হলেও শুভ
বেছে নেন অন্য পথ। কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও
গণিতে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ (বর্তমানে
ইউনিভার্সিটি অব মাউন্ট ইউনিয়ন) থেকে। তিনি ১৯৯৫ সালে কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ
ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ প্রকৌশল ও ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং ২০০১ সালে
তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
শুভ রায়রা তিন ভাইবোনই বর্তমানে থাকেন
যুক্তরাষ্ট্রে। ছোট ভাই জয় রায় পেশায় ভাসকুলার সার্জন। বোন চৈতী রায় অ্যানেসথেটিক।
১৯৯৮ সালে শুভ ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিকের
বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রজেক্ট স্টাফ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮
সাল পর্যন্ত ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়ো মাইক্রো ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস
ল্যাবরেটরীর সহ পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্লীভল্যান্ড
ক্লিনিকের স্পাইন রিসার্চ ল্যাবরেটরীতে কাজ করেন শুভ। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত
ক্লীভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির ফলিত বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের
সহকারী অধ্যাপক এবং কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশল ও
কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল
পর্যন্ত তিনি ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী
স্টাফ হিসেবে কাজ করেন। এরপর ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিক
লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের মলিকুলার মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত
ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া এট সান ফ্রান্সিস্কোর
বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড থেরাপিউটিক সায়েন্সের Harry Wm. and Diana V.
Hind Distinguished সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ২০০৯ থেকে তিনি
ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিকের নেফ্রোলজি বিভাগের এডজাংক্ট সহকারী স্টাফ হিসেবে কর্মরত।
৪০ জন সহকর্মী নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন শুভ। গত তিনটি বছর
নিরবচ্ছিন্নভাবে এ কাজে সময় ব্যয় করেছেন তিনি এবং তাঁর গবেষক দল।
তথ্যসূত্র- প্রথম আলো, আনন্দবাজার , উইকিপিডিয়া
Post a Comment