বাংলা ও বাঙালির গর্ব কিংবদন্তি ফুটবলার "চীনের প্রাচীর" গোষ্ঠ পাল
সালটা ১৯১৫। তখন মোহনবাগান সচিব শ্রী শৈলেন বসু। শৈলেন বাবু গোষ্ঠ পালকে ডেকে বললেন তিনি ১২ টি ব্যাজ কিনেছেন, মোহনবাগানের অমর একাদশ এর ১১ জনকে আগেই দিয়েছেন সেই ব্যাজ, আর একটা ব্যাজ আছে, সেটা তিনি দিলেন গোষ্ঠ পালকে। তিনি গোষ্ঠ পালকে বললেন কথা দিতে যাতে তিনি কখনো
মোহনবাগান না ছাড়েন। গোষ্ঠ পাল সেই কথা রেখেছিলেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগানের হয়ে তিনি প্রথম খেলেন। এরপর ২৩ বছর ধরে মোহনবাগানের
হয়ে তিনি খেলেন। তিনি খেলতেন রাইট ব্যাক পজিসনে।
গোষ্ঠ পালের জন্ম ১৮৯৬ সালের ২০ আগস্ট। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের
ফরিদপুরের ভোজেস্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর বাবা শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল ছিলেন একজন
ব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল
ছিল গোষ্ঠ পালের ধ্যানজ্ঞান , তাই ওনার বাবাও তাঁকে বাধা দেননি। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি কলকাতার একটি ক্লাবে খেলার
সুযোগ পান। এই বয়সেই তিনি কুমারটুলির
হয়ে মাঠে নামেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত
তিনি কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলেছেন। ১৯১১ সালে মোহনবাগান প্রথম আই এফ এ শিল্ড জয়লাভ করে। আই এফ এ শিল্ড এর সেমিফাইনাল ম্যাচ এর আগে কালীচরণ মিত্র (কালী মিত্তির) কুমারটুলি ক্লাবে যান ক্লাবের খেলা দেখতে। কালীচরণ মিত্র ছিলেন আই এফ এ শিল্ড এর পরিচালন সমিতির
ভারতীয় সদস্য। এছাড়াও তিনি শোভাবাজার
ক্লাব এর সাথেও যুক্ত ছিলেন। বাংলায় ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কালীচরণ মিত্র এর অবদান অনস্বীকার্য। সেদিনের বৃষ্টিস্নাত দিনে গোষ্ঠ পালের ভয়ডরহীন ফুটবল
দাগ কেটেছিল কালীচরণ মিত্র এর মনে। তিনি গোষ্ঠ পালকে নিয়ে যান এরিয়ান ক্লাব এর অধিকর্তা দুখিরাম মজুমদার এর কাছে। তারপর বাকিটা ইতিহাস।
এরপর মোহনবাগানের খেলোয়াড় রাজেন সেনগুপ্ত এবং মেজর
শৈলেন বসুর সাহায্যে গোষ্ঠ পাল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগান দলে যোগ দেন। তিনি খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে। আই এফ এ শিল্ড জয়ী দলের সদস্য ভূতি সুকুল,
নীলমাধব ভট্টাচার্য্য, হাবুল সরকারের সাথে জুটি বেঁধে গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান রক্ষণ সামলানো শুরু করেন। ১৯১৪ সালে মোহনবাগান ক্যালকাটা ফুটবল লীগের বি ডিভিশনে
প্রথম হয় এবং প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে ক্যালকাটা ফুটবল লীগের এ ডিভিশনে খেলার সুযোগ
পায়। ১৯১৫ সালে ক্যালকাটা ফুটবল লীগের
এ ডিভিশনে মোহনবাগান চতুর্থ হয়। ১৯১৬ সালে মোহনবাগান ক্যালকাটা ফুটবল লীগ জয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলো,
কিন্তু শেষ অবধি তাদের রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ১৯২১ সালে গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান এর অধিনায়ক নির্বাচিত
হন। এরপর ১৯২৬ সাল অবধি দীর্ঘ ৫
বছর গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান এর অধিনায়ক ছিলেন। ১৯২৩ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে মোহনবাগান দ্বিতীয়বার আই এফ এ শিল্ড জয়ের খুব কাছাকাছি
চলে এসেছিলো, কিন্তু ফাইনালে মোহনবাগান ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের
কাছে ৩-০ গোলে পরাজিত হয়। ওই বছরেই মোহনবাগান গোষ্ঠ পাল এর অধিনায়কত্বে প্রথম ভারতীয় ফুটবল ক্লাব হিসাবে
রোভার্স কাপে খেলার সুযোগ পায়। আর প্রথম সুযোগেই বাজিমাত। মোহনবাগান প্রথম বছরেই রোভার্স কাপ এর ফাইনালে ওঠে কিন্তু ফাইনালে ডরহম লাইট ইনফ্যানিটি
ক্লাব এর কাছে ৪-১ গোলে পরাজিত হয়। কিন্তু মোহনবাগানের এই সাফল্য ক্লাবের জনপ্রিয়তা বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। ১৯২৪ সালে গোষ্ঠ পাল ভারতীয় জাতীয় দলেরও অধিনায়কত্ব
পান। এরপর ১৯২৫ সালে মোহনবাগান গোষ্ঠ
পাল এর অধিনায়কত্বে প্রথম ভারতীয় ফুটবল ক্লাব হিসাবে ডুরান্ড কাপে খেলার সুযোগ পায়। মোহনবাগান প্রথম সুযোগেই সেমিফাইনাল এ ওঠে,
কিন্তু সেমিফাইনালে শেরউড ফরেস্ট টীম এর কাছে পরাজিত হয়। ভারতীয় দল নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহলে
(বর্তমান শ্রীলঙ্কা) যান। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের
অধিনায়ক নির্বাচিত হন। পরে তিনি আঘাতের কারণে
যেতে পারেন নি। তাঁর মাঠ থেকে সরে যাওয়ার
কারণও ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই। একটি ম্যাচে ব্রিটিশ রেফারির পক্ষপাতিত্বমূলক
আচরণের প্রতিবাদে মাঠে শুয়ে পড়েন গোষ্ঠবাবু। এই কারণে তাঁকে সাসপেন্ড করে আইএফএ। সে কথা জানতে পেরেই খেলা ছেড়ে দেন তিনি। ফুটবল ছাড়াও তিনি হকি, ক্রিকেট ও টেনিস খেলতেন। চারটি খেলাতেই তিনি মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন। মোহনবাগান না ছাড়লেও তিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে একটি
ম্যাচ খেলেছিলেন। ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গলের
প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই শ্যাম পার্কে একটি প্রতিযোগিতায় লাল হলুদ জার্সি গায়ে খেলেন
গোষ্ঠবাবু। তিনিই ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রথম
অধিনায়ক।
গোষ্ঠ পাল বাংলা ও বাঙালীর গর্ব। তিনি কিংবদন্তি। তিনি ভিনদেশীদের বিরুদ্ধে এ দেশের লড়াই। খেলার সময় বুটপরা ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে
গোষ্ঠ পাল খালি পায়ে খেলে প্রতিরোধ করতেন। পরাধীন ভারতে সবুজ-মেরুন রঙের জার্সি গায়ে মোহনবাগান
রক্ষণে তাঁর বিক্রমকে ভয় পেত বুট পরা ইংরেজ ফুটবলাররাও। ১৯২৮ সালে ইস্টবেঙ্গল তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলো ১ লক্ষ
টাকা ও পার্ক স্ট্রিটে বাড়ি দেওয়ার, কিন্তু গোষ্ঠ পাল সেই
প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান সম্পর্কে বলতেন ক্লাব হল তাঁর মায়ের মত, তিনি কোনোদিনও ক্লাব থেকে টাকা নেননি। গোষ্ঠ পাল ছিলেন জেল না খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী, তিনি কোনোদিন ব্রিটিশের চাকরি করেননি। গোষ্ঠ পাল এর পরিবারকে ব্রিটিশরা চৌধুরী উপাধি দিলেও, গোষ্ঠ পাল কোনোদিনও সে উপাধি ব্যবহার করেননি। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে গোষ্ঠ
পাল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাননি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে গোষ্ঠ পাল অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বলতেন দেশের জন্যে যদি কেউ ভাবে তাহলে তিনি
হলেন নেতাজি। নেতাজি থাকলে দেশ অন্যরকম হত,
দেশভাগ হত না।
১৯১১ সালে মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জেতার পর বাংলায়
মোহনবাগানকে নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়। ব্রিটিশরা এটা মেনে নিতে পারতো না। তাই ১৯১১ পরবর্তী সময়ে মোহনবাগান এর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করতেন রেফারীরা। কিন্তু তারপরেও ব্রিটিশরা গোষ্ঠ পালের খেলার ভক্ত
ছিলেন। দৈনিক ইংলিশম্যান তাঁকে
"চিনের প্রাচীর" উপাধিতে ভূষিত করেছিল। ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ গোষ্ঠ পাল এর খেলা দেখতে মাঠ এ আসতেন। সেই খেলা দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাই তিনি
নিজে "পদ্মশ্রী" পুরস্কারের জন্যে গোষ্ঠ পালের নাম মনোনীত করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে গোষ্ঠ পাল ভারত সরকার দ্বারা পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ছিলেন প্রথম ফুটবল খেলোয়াড় যিনি পদ্মশ্রী
উপাধি পেয়েছিলেন। মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ সালে তাঁকে মরনোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। কলকাতায় ইডেন গার্ডেন্স এর বিপরীতে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা
হয়েছে এবং ওই রাস্তাটি গোষ্ঠ পাল সরণি নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে ভারত সরকার গোষ্ঠ পালের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁর নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ
করেন, তিনিই প্রথম ফুটবলার যার নামে ডাকটিকিট প্রকাশিত
হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গোষ্ঠ পালকে শ্রদ্ধা করতেন। অন্য ফুটবলারদের মধ্যেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯২৯ সালে ডুরান্ড কাপের একটি ম্যাচে বিদেশি ফুটবলার মুসার আক্রমণে গোষ্ঠ পালের
হাত ভেঙে যায়। ওই বছরেই এরিয়ান ক্লাব
এর ফুটবলার তুলসী দাস একটি ম্যাচে মুসাকে আক্রমণ করেন। তুলসী দাসকে পরে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, যেহেতু মুসা আক্রমণ করে গোষ্ঠ পালের হাত ভেঙে দিয়েছিলেন, তাই তিনি মুসাকে আক্রমণ করে সেটার বদলা নিলেন।
গোষ্ঠ পাল চাইতেন মোহনবাগানের প্রাক্তন ফুটবলারদের
পাওয়া পুরস্কার, ছবি, স্মারক দিয়ে একটি সংগ্রহশালা
তৈরী হোক। ক্রীড়াপ্রেমীরা টিকিট কেটে সেই
সংগ্রহশালা দেখতে আসলে ক্লাব যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবে তেমনি ইতিহাসও সংরক্ষিত থাকবে। ১৯৭৬-এ মারা যান তিনি। ১৯৯২ সালের ২০ শে অগস্ট গোষ্ঠ পালের ইচ্ছানুয়ায়ী মোহনবাগানের ব্যাজ, পদ্মশ্রী পুরস্কার, বাকি সমস্ত পুরস্কার,
ট্রফি গোষ্ঠ পালের ছেলে নীরাংশুবাবু দিয়ে এসেছিলেন মোহনবাগানের
হাতে। কিন্তু ২৭ বছরেও সেই পুরস্কারগুলো
রাখা হয়নি ক্লাবের সংগ্রহশালায়। উল্টে সেগুলোর অমর্যাদা করা হয়েছে। ২৭ বছর কম সময় নয়। এর মধ্যে বহু বার ক্লাবকর্তাদের
চিঠি দিয়েছিল গোষ্ঠ পালের পরিবার। সেই সব আবেদনে কর্ণপাত করা হয়নি। এগুলো ফেরত নিতেই নীরাংশুবাবুকে কিছুদিন আগে ফোন করা হয়েছিল ক্লাবের তরফে। পুরনো জিনিস ফেরত পাওয়ার আনন্দ নিয়ে শতাব্দীপ্রাচীন
ক্লাবে গিয়েছিলেন তিনি। বহু বছর ধরেই ক্লাবকে
দেওয়া ওই সমস্ত জিনিসের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এত দিন পর সেগুলো ফিরে পাওয়া যাবে এই আনন্দে ক্লাবে
গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, কিছু ক্ষণের মধ্যেই সব উবে যায়। ক্লাবে পৌঁছনোর পর একটি বাজারের ব্যাগ তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়, যার ভেতরে ছিল ‘চিনের প্রাচীরের’ হারিয়ে যাওয়া পুরস্কারগুলো। তার কোনওটা ভেঙে গিয়েছে, ইঁদুরের কামড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন
হয়ে গিয়েছে দামি মানপত্র! এ দিন তাঁর হাতে যে সমস্ত জিনিস
তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে ছিল না পদ্মশ্রী পদক। দুর্মূল্য ব্যাজেরও খোঁজ মেলেনি। এতটা অযত্ন কি প্রাপ্য ছিল কিংবদন্তি গোষ্ঠ পালের?
ইতিহাসের এক শিহরণের নাম গোষ্ঠ পাল। তাঁকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে কত ঘটনা। সেই গোষ্ঠ পালই পেলেন না সম্মান! প্রশ্ন তুলছেন গোষ্ঠপ্রেমীরা। কিন্তু, কোথায় গেল সেই সব অমূল্য ট্রফি? সদুত্তর পাননি গোষ্ঠ পালের পরিবার।
গোষ্ঠ পাল বাংলা ও বাঙালীর গর্ব। তিনি কিংবদন্তি। তিনি ভিনদেশীদের বিরুদ্ধে এ দেশের
লড়াই। ১৯৭৬ সালের ৮ ই এপ্রিল তিনি
আমাদের ছেড়ে চলে যান। যিনি খালি পা নিয়ে ২৩ বছর মোহনবাগান রক্ষণ প্রাণ দিয়ে সামলেছেন, তাঁর এই অসম্মান মেনে নেওয়া যায় না। গোষ্ঠ পালের অপমান সমগ্র বাঙালি জাতির অপমান,
এ ঘটনা একজন বাঙালি হিসাবে লজ্জার। মোহনবাগানের যেসব কর্মকর্তা এর জন্যে দায়ী, তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই।
Post a Comment