রন্টুদা (কৃশানু দে) বাঙালি তোমার ড্রিবল আজও ভোলেনি, তুমি বাংলার ফুটবলের অহংকার
সালটা ১৯৯০। সন্তোষ ট্রফি খেলতে
বাংলার টিম তখন বেঙ্গালুরুতে রন্টুদার সাথে পনিদি (ওনার স্ত্রী) গিয়েছিলেন। সেইবার পনিদির পিসির বাড়ি ছিল চেন্নাই,পনিদি কে পিসেমশাই চেন্নাই স্টেশন থেকে পিসির
বাড়ি নিয়ে গেলেন, বাংলার টিম এরপর যাবে বেঙ্গালুরুতে। মোহনবাগানের অঞ্জন মিত্রের কাছে কোনোভাবে এই খবরটা পৌঁছে
গেলো। কিন্তু পনিদির পিসির বাড়িতে রাত প্রায়
বারোটা নাগাদ হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই দেখা যায় অতনুদা (ভট্টাচার্য), লালুদা(বিকাশ পাঁজা) দাঁড়িয়ে। তারা পনিদিকে বললেন
বেঙ্গালুরু যাওয়ার ট্রেন
মিস হয়ে গেছে, রন্টুদা চেন্নাই এর হোটেলেই আছে, পনিদি যেন এখনই তাদের
সাথে একবার আসেন। পনিদি রাজি হলেন,পৌঁছালেন হোটেল। গিয়ে পনিদি দেখলেন, মোহনবাগানের অঞ্জনদা, বীরুদা বসে আছেন হোটেলে। লালুদার তখন সই করা হয়ে গেছে। অঞ্জনদা আইসক্রিমের অর্ডার দিল। সই করার ঠিক আগের মুহূর্ত। হোটেল-ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। নির্ঘাৎ আইসক্রিম এসে গেছে। দরজা খুলে পুরো চমকে উঠলাম
সবাই। ইস্টবেঙ্গলের সুপ্রকাশ গড়গড়ি। খালি পা। এলোমেলো চুল। সিল্কের লুঙি। যাহোক-তাহোক করে চাপানো শার্ট। উদভ্রান্তের মতো সোজা ঘরে ঢুকে এল। সুপ্রকাশ বাবু অঞ্জনদার সামনে
হাত জোড় করে বললেন, বিকাশ আর রন্টুদাকে ইস্টবেঙ্গল এর জন্যে
ছেড়ে দিতে, এর বদলে চিমাকে মোহনবাগানে ছাড়তেও তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিকাশ
আর রন্টুদাকে না ছাড়লে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা তার ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেবেন। পুরো কান্নাকাটি শুরু করে দিল গড়গড়িদা। শেষমেশ তিনি অঞ্জনদাকে রাজি করলেন রন্টুদার জন্যে, কিন্তু লালুদা সই করে ফেলেছেন, তাই লালুদাকে ছাড়তে
রাজি হলেন না অঞ্জনদা। লালুদা আবার কখনো রুন্টুদাকে ছাড়া খেলেননি, তাই লালুদা বেঁকে
বসলেন। চুক্তিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ইস্টবেঙ্গলের দুই ঘরের ছেলে আবার ঘরেই থেকে গেল। এরপর সবাই বেরিয়ে একটা হোটেলে উঠলো, সবাই মিলে একটাই ঘরে। সারা রাত সবাই জেগে। হুল্লোড় চলল সারাক্ষণ। ভোরবেলা গড়গড়িদাকে চটি কিনে দেওয়া
হল। আর পনিদিকে পৌঁছে দেওয়া হল পিসির বাড়ি। পরে গড়গড়িদাকে পনিদি জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি কিকরে জানলেন অঞ্জনদা রন্টুদাকে সই করতে আসছেন? গড়গড়িদা বলেছিলেন, তিনি একটা আঁচ পেয়েছিলেন। চটি পড়েননি। জামাপ্যান্ট পাল্টানোরও সুযোগ পাননি। সাত তাড়াতাড়ি দমদম এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলেন অঞ্জনদা ফ্লাইট ধরতে যাচ্ছে। তখন কোনও ক্রমে
গ্রাউন্ডের লোকদের ম্যানেজ করে উঠে পড়েছিলেন প্লেনে। ১৯৯০ বছরটাও তো ছিল রন্টুদার কাছে স্মরণীয়। ইস্টবেঙ্গলের ত্রিমুকুট জেতা থেকে কপিল দেবের
হাত থেকে সেরা ফুটবলার হওয়ার
ট্রফি পাওয়া, সব একসাথে।
কৃশানু দে ওরফে রন্টুদা বাংলা
ও বাঙালির গর্ব। তিনি বাংলার ফুটবলের অহংকার। কৃশানু দের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় খেলোয়াড় জীবনে তিনি আক্রমণাত্বক মিডফিল্ডার ছিলেন এবং তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্যের জন্য ভারতীয় মারাদোনা নামে সুপরিচিত ছিলেন। গোটা দেশ তাঁকে চিনেছে এমন একজন ফুটবলার হিসাবে যে মাঠে তাঁর ঈশ্বরপ্রদত্ত দক্ষতার প্রমাণ রাখে। প্রতি মুহূর্তে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে। নাকতলার বাসিন্দা রন্টুদার প্রথম
জীবনে ক্রিকেট ছিল ধ্যান জ্ঞান। তিনি বিভিন্ন পাড়ার
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। এর পাশাপাশি ফুটবলটাও খেলতেন। রন্টুদার পাড়ার
ক্লাবের নাম ছিল প্রভাত সংঘ। ক্লাবের এক দাদার (সান্টুদার) হাত ধরে রন্টুদা প্রথম
যান ফুটবল কোচ অচ্যুত বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাছে। রবীন্দ্র সরোবরের পাশের মাঠে উনি প্র্যাকটিস করাতেন। সেখানে একবার
এক স্থানীয় প্রতিযোগিতায় রন্টুদা গোলকিপার হিসাবে খেলেন আর সোনার
আংটি উপহার পান। কিন্তু অচ্যুত্দা বুঝেছিলেন গোলকিপার জায়গাটা রন্টুদার জন্যে নয়, তিনি রন্টুদাকে মিডফিল্ডার হিসাবে খেলাতে শুরু করেন আর তারপর রন্টুদাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৭৯ সালে রন্টুদা কলকাতা লীগ খেলেন, তাঁর প্রথম
ক্লাব ছিল কলকাতা পুলিশ। এরপর ১৯৮০ তে তিনি যোগ দেন পোর্ট ট্রাস্ট ক্লাবে। পোর্টে খেলার
সময় শৈলেন মান্নার চোখে পড়ে রন্টুদার শৈল্পিক পাসিং আর ড্রিবলিং। শৈলেন মান্না মোহনবাগান ক্লাবকে জানান
রুন্টুদার কথা, এরপর মোহনবাগান প্রস্তাব দেয় রন্টুদাকে। ১৯৮২ সালে রন্টুদা মোহনবাগানে যোগদান করেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মোহনবাগানে খেলার সময় সঙ্গে রন্টুদার সাথে আলাপ হল লালুর। লালু মানে, বিকাশ পাঁজি। ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে, সেটা শুধু মাঠ নয়, মাঠের বাইরেও চলে এল। এমন অনেক সময় হয়েছে যে রন্টুর জন্য কম টাকায়
খেলছে বিকাশ। আবার উল্টোটাও হয়েছে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব কতটা গভীর থাকলে
অমনটা সম্ভব! মাঠে ওদের যে বোঝাপড়া ছিল, তার জন্য এই বন্ধুত্বটাও খানিকটা কাজে দেয়। দুজনে দুজনকে এত ভাল চিনত যে হাবেভাবেই একজন বুঝে যেত, অন্যজন কী চায়। সেই সময় সুরজিৎ সেনগুপ্ত রন্টুদা কে খুব সাহায্য করেছিলেন, খেলায় ভুল হলে ধরিয়ে
দিতেন। সাহায্য করেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য্য। মহামেডানের বিরুদ্ধে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে তাঁর খেলা এখনও চোখে ভাসে। সেবার সাদা-কালো দলকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিল্ড
জেতে মোহনবাগান। কৃশানু দে দলের হয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ৮২ থেকে ৮৪ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর কৃশানু মোহনবাগানে খেলেন। ১৯৮৩ সালে ভারতীয় দলে সুযোগ পান কৃশানু। জাতীয় দলের হয়ে নেহরু
কাপে খেলেন। ৮৪ সালে মোহনবাগানের হয়ে লিগ জয়ে বড় ভূমিকা নেন কৃশানু।
মোহনবাগানে প্রায় ৩ বছর কাটানোর পর ১৯৮৫ সালে রন্টুদা ইস্টবেঙ্গলে যোগদান করেন। দলবদলের সময় ইস্টবেঙ্গলের পল্টুদা ৩ দিন রন্টুদার বাড়ির সামনে পাহারা দিয়েছিলেন যাতে মোহনবাগানে যেন অন্য কোনো দল রন্টুদাকে সই করতে না পারে। রন্টুদার ইস্টবেঙ্গলের কথা বলতেই
মনে আসে ১৯৮৫ তে যুবভারতীতে মহামেডানের সাথে ম্যাচের কথা। ওই সময় পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় কোচ ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের। তিনি প্রথমে নামাননি রন্টুদাকে, দুঃখ পেয়েছিলেন রন্টুদা। খেলা শুরুর সাথে সাথেই চিমার
গোলে পিছিয়ে যায় লাল হলুদ শিবির। খেলা শুরুর অনেক পরে নামানো হয় রন্টুদাকে। নেমেই দুটো পাস। তার থেকে দুটো গোল। মাঠে যেন সে দিন ফুল ফুটিয়েছিল রন্টুদা। ড্রিবলের পর ড্রিবল। নিখুঁত চেরা পাস। কিছুতেই রোখা যাচ্ছিল না ওকে। ম্যাচের পর বাচ্চার মতো টগবগ করে ফুটছিল ও। অভিনন্দনে-আদরে-আবেগে ভেসে গিয়েছিল। এতদিন বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবল
শুধু দেখেছিল কৃশানুর মতো একজন শিল্পী ফুটবলারকে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে বাংলার ফুটবল
প্রেমীরা দেখল কৃশানু দে-বিকাশ পাঁজি জুটি। এই বছর ‘কৃশানু-বিকাশ’ জুটিকে তুলে নেয় ইস্টবেঙ্গল। সেবার শিল্ডে গ্রুপ
লিগের ম্যাচে সবুজ-মেরুনের বিরুদ্ধে একটি দুরন্ত গোল করেছিলেন কৃশানু। ঠিকানা লেখা পাস বাড়াচ্ছেন কৃশানু, সেই পাস ধরে গোল করছেন বিকাশ। আবার কখনও চিমা ওকেরি। এর পরেই মারডেকায় রন্টুদার হ্যাটট্রিক!
১৯৮৮ সালে রন্টুদার সাথে বিয়ে হয় পনিদির। রন্টুদার কার্টিলেজ ছিঁড়ে যাওয়ায় তখন তিনি মাঠের
বাইরে। খেলা বন্ধ। মাঠের বাইরে দমবন্ধ করা জীবন। একদিন
রন্টুদা আর পনিদি
গড়িয়াহাটে গেছেন কেনাকাটা করতে, কিছু স্থানীয় ছেলে রন্টুদাকে ল্যাংড়া বলে কটাক্ষ করেছিল। বহুলোক বলতো রন্টুদার ফুটবল
জীবন শেষ। কিন্তু তিনি রন্টুদা ,ফুটবল তার রক্তে। শুরু হলো দাঁতে
দাঁত চেপে লড়াই। এই কঠিন সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান নইমদা। প্রতিদিন কাকভোরে উঠে রেস কোর্সে প্র্যাকটিস শুরু হলো। ওই সময়টায় আরেক জন— সুদীপদা (সুদীপ চট্টোপাধ্যায়)! প্রাণপাত করেছিল রন্টুদার জন্য! এক কথায় বলতে গেলে, তখন রন্টুদার কোচ হয়ে উঠেছিল সুদীপদা। ১৯৮৯-এ ইস্টবেঙ্গল থেকে প্রস্তাব এল। কিন্তু মাত্র ২৫০০০ টাকা দেয়ার কথা হলো ক্লাব
থেকে। সেদিন
রন্টুদা লাল-হলুদ শিবিরকে বলেছিলেন আমার টাকা লাগবে না, যদি ভালো খেলি তখন টাকা দেবেন। সেই মরসুমে মাঠে ফিরে দুর্দান্ত খেলল রন্টুদা। তাতে ওর ‘দর’ ও গেল বেড়ে। এয়ারলাইন্স কাপে পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করে আখ্যা
পেল ‘মারাদোনা’! ১৯৮৯ সালে লাল-হলুদের অধিনায়ক নির্বাচিত হন কৃশানু। সেবার
ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ জেতে। পাশাপাশি ছবছর পরে ডুরান্তও। এর পরে ইতিহাস এর পর ৯০ সালে ইস্টবেঙ্গলের ত্রি-মুকুট জয়ের
ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ফেলেন তিনি। শিল্ড, ডুরান্ড এবং রোভার্স কাপ জেতার পিছনে
কৃশানুর অবদান অপরীসীম। ১৯৯১ সালে ডুরান্ত জিতে হ্যাটট্রিক করে লাল-হলুদ। সেবারও ঝলসে উঠেছিল কৃশানুর বাঁ পা। এরপর ১৯৯১ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলেই ছিলেন রন্টুদা। ১৯৯২ সালে তিনি আবার মোহনবাগানে যোগদান করেন। তখন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে রন্টুদার বাড়িতে ইটবৃষ্টি হয়। পাঁচ দিন টানা পুলিশি পাহারা নিতে হয়। সমর্থকরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলেন। এগিয়ে আসেন পনিদি, বোতলে রাখা কার্টিলেজ দেখিয়ে সমর্থকদের বলেন আপনারাই তো রন্টুদাকে একদিন ল্যাংড়া বলেছিলেন, ভুলে গেলেন সেসব দিনের কথা? এরপর পনিদি
কথা দেন পরের বছর রন্টুদা আবার ইস্টবেঙ্গলে ফিরে আসবেই। তাতে শান্ত
হন সমর্থকরা। সেইসময় দলবদল
নিয়ে সাংঘাতিক উন্মাদনা ছিল। ঘোড়ার গাড়ি
চড়ে সই করতে যাওয়া। সমর্থকদের পিঠে বসে সই করতে যাওয়া, এসব ছিল প্রত্যেক বছরের দৃশ্য। আজকাল এসব আর ভাবাই যায় না। এরপর ১৯৯৪ সালে রন্টুদা আবার ফিরে আসেন ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৯৫ সালে যোগ দেন ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার টিমে। ওই টিম থেকেই
১৯৯৭ সালে তিনি অবসর নেন। এরপর তিনি কিছুদিন কোচিং করান ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ও কালীঘাট ক্লাবকে।
শিল্পী ফুটবলার কৃশানু দের কথা উঠলেই
আমেদ খাঁ, চুনী গোস্বামী, পরিমল দে, কাজল মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। এই অনন্য শিল্পী ফুটবলারদের পরেই আসবেন
কৃশানু। ওর ঠিকানা লেখা পাস এবং ড্রিবলিং স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে। বিকাশের সঙ্গে ওর জুটি ছাড়াও চিমার
সঙ্গেও চমৎকার জুগলবন্দী ছিল। ওর সৃজনশীল পাস ধরেই চিমা একের পর এক গোল করে দলকে ম্যাচ জিতিয়ে গিয়েছেন। বিপক্ষ কোচেরা সব সময় কৃশানুকে নিয়ে
যাবতীয় পরিকল্পনা করতেন। একজন মার্কার রাখতেই হত কৃশানুর জন্য। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ফুটবলার ছিলেন। কীভাবে মার্কার এবং ডিফেন্ডারদের বোকা বানাতে হয় তা ভালই জানতেন কৃশানু।
বলিউডের নায়কদের মধ্যে
রাজেশ খান্নার অন্ধভক্ত ছিল রন্টুদা। তিনি তাঁর কোনও ছবি মিস করতেন না। ভিসিডি-তে বরাবরই রাজেশ খান্নার ‘আনন্দ’ দেখত, ততবারই চোখের জলে ভাসাতেন। খুব ভালোবাসতেন ইলিশ মাছ আর ক্রিকেট। অবসর নেবার পর এই দুইয়েও যেন পেয়ে বসেছিল রন্টুদাকে। রন্টুদার ছেলে রুব্বা ওর প্রাণের চেয়েও
প্রিয়। গায়ে হাত দেওয়া দূরে থাক, কোনও দিন বকাঝকাও করেননি ওকে। রন্টুদার পরিচয় একজন অসম্ভব লাজুক, বিনয়ী, নম্র স্বভাবের মানুষ হিসেবে। মাটির
মানুষ বললেও কম বলা হয়। গালিগালাজ তো কোন ছার, কোনও দিন উঁচু গলায় কথা বলতেন না রন্টুদা। ময়দানের সকলের প্রিয় ছিলেন
রন্টুদা। মাঠের কৃশানুর থেকে একদম আলাদা। শান্তশিষ্ট ছেলেটা মাঠে নামলে কী ভয়ঙ্কর ভাবে পাল্টে যায়! লম্বা লম্বা
শক্তপোক্ত চেহারার সব ডিফেন্ডারকে চোখের নিমেষে কী করে পেরিয়ে যায়! বাড়িতে এলে সেই মানুষটারই মুখে ‘রা’ সরত না !
২০০২ সেপ্টেম্বর দার্জিলিঙে অফিসের হয়ে খেলতে
গিয়ে পা ভেঙে বাড়ি ফেরেন
রন্টুদা। টানা ছয়মাস
প্রায় ভুগল রন্টুদা। কিছুতেই পুরোপুরি সুস্থ
হচ্ছিলেন না। মার্চের ১৩, হঠাৎ ব্লাড প্রেসার প্রচণ্ড কমে গেল। ল্যান্সডাউন নার্সিং হোমে ভর্তি
করা হল। অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকে। নার্সিংহোম বদলিও করা হল উডল্যান্ডসে। তাতেও কিছু হল না। পালমোনারি এমবলিজমে ধরল। জমাট রক্ত আক্রমণ করে বসল ফুসফুসে। ২০ মার্চ ২০০৩। দুপুরবেলা। আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন
রন্টুদা।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন রন্টুদাকে। তিনি ছিলেন তাঁর খেলার অন্ধ ভক্ত। ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ভারতের যাবতীয় পারফরম্যান্স রন্টুদার নামে উত্সর্গ করেছে ভারতীয় দলের অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। পরে ইস্টবেঙ্গলে রন্টুর শোকসভাতেও এসেছিল সৌরভ। সৌরভ পনিদিকে বলেছিল, রন্টুর খেলা কতটা ভালবাসত ও। ছোটবেলার নায়ককেই যেন হারিয়েছে ও। কত ফুটবলার চার-পাঁচ বছর খেলেও আজকাল
সব অর্জুন পাচ্ছে। কিন্তু ‘ভারতীয় মারাদোনার’ আজ অবধি কপালে
কিচ্ছুটি জুটল না। একটা বেনিফিট ম্যাচ পর্যন্ত হল না ওর জন্য। এতটা তাচ্ছিল্য কি পাওনা ছিল মানুষটার? হয়তো না।
কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে
আজও রন্টুদা বেঁচে
আছেন। আজও বাঙালি মাঠে যায়,কিন্তু আর একটা কৃশানুকে দেখতে
পাওয়া যায় না। কৃশানু দে এর ড্রিবল বাঙালি আজও ভোলেনি। সমর্থকদের এই ভালবাসা পাওয়া তো কোটি টাকার চেয়েও
দামি। অনেক সম্মানের চেয়ে বড় সম্মান। খুব কম খেলোয়াড়ের সৌভাগ্য হয় এমন ভাবে সমর্থকদের মনে ঠাঁই নেওয়ার। রন্টুদা সে দিক থেকে তো ভাগ্যবান।
২০ শে মার্চ, ২০০৩ রন্টুদা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বাংলার বর্তমান যুবসমাজ মেসি, রোনাল্ডো এদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত। রন্টুদার নাম তাদের কাছে অপরিচিত। রন্টুদাকে যেন বাঙালি ভুলে না যায়, তিনি অমর। যেখানেই আছেন, ভালো থাকবেন রন্টুদা।
Post a Comment