বিস্মৃতি সরিয়ে ফিরিয়ে দেখা অগ্নিযুগের এক দেশপ্রেমিককে
১৯১২ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর। সময় সকাল ১১টা বেজে ৪৫মিনিট। হাতির পিঠে বসা সস্ত্রীক বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লী
স্টেশন থেকে দিল্লীর চাঁদনী চকের পথ ধরে আম-দরবারে যাচ্ছিলেন বঙ্গভঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই। অসংখ্য মহিলা পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের তৃতীয় তলায় শোভাযাত্রা দেখার জন্য
অপেক্ষা করছেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী
সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এবং ষোড়শী বালিকা লীলাবতী। রাসবিহারী বসু
সবকিছু সর্তকতার সাথে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। লীলাবতীও রাসবিহারী বসুর ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন সময় এক মহিলা লীলাবতীকে
জিজ্ঞেস করে "তেরি নাম ক্যা বহিনী?" লীলাবতী রাসবিহারীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন,"মেরী নাম লীলাবতী"। ততক্ষণে শোভাযাত্রাটি ভবনের একেবারে নিকটে চলে এসেছে। রাসবিহারী বসু মহিলাদের দৃষ্টি শোভাযাত্রা ফেরানোর
জন্য জোরে বলে উঠেন, "বড় আজব, সামনে দেখ বাহিনী"। মহিলারা অন্যদিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে রাসবিহারী বসু লীলাবতীকে ইঙ্গিত দেন। লীলাবতী তৎক্ষণাৎ বড়লাটকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ
করেন। হাতির গায়ে বোমাটা পড়ায় লর্ড
হার্ডিঞ্জ আহত হয়ে নীচে পড়ে যান, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। হাতির পিঠে বসে থাকা লেডী হার্ডিঞ্জ সংজ্ঞাহীন হয়ে
পড়েন। ঘটনায় বড়লাটের পার্শ্বচর এক
জমাদার ও মাহুত মারা যান। বোমার আঘাতে একটা ছোট ছেলেরও মৃত্যু হয়। ষোড়শী বালিকা লীলাবতী বেশে যিনি ছিলেন তিনি হলেন বসন্ত বিশ্বাস। পরিকল্পনা মত মুহূর্তের মধ্যে রাসবিহারী বসু আর বসন্ত
বিশ্বাস জনারণ্যে মিশে গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে উধাও হয়ে যান। রাসবিহারী চলে যান তাঁর কর্মস্থল দেরাদুনে আর বসন্তকুমার
বিশ্বাস লাহোরে। সেখানে পপুলার ডিস্পেনসারি
নামের একটা ফার্মেসী তে বসন্ত এই ঘটনার মাস-দুই আগে কম্পাউন্ডার হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। রাসবিহারীই বসন্তকে দেরাদুন থেকে লাহোরে নিয়ে গিয়েছিলেন। হার্ডিঞ্জকে মারার জন্য যে বোমা ব্যবহৃত হয়েছিল তা
চন্দননগরের বিপ্লবী মণীন্দ্রনাথ নায়েক নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন এবং নলিনচন্দ্র দত্ত
ওরফে পশুপতি সেই বোমা ট্রেনে করে নিয়ে গিয়ে রাসবিহারীর হাতে দিয়ে এসেছিলেন।
এরপর লাহোরের লরেন্স গার্ডেন্স-এর ইংরেজদের নাইট ক্লাবে কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট গর্ডন ও অন্যান্য ইংরেজ পুলিশ অফিসারদের
মারার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবারও এই কাজের ভার পরে বসন্তের উপর। পরিকল্পনা মত ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ ই ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে বসন্তকুমার বিশ্বাস
নাইট ক্লাবের রাস্তায় একটা বোমা রেখে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এবারও সাইকেল চালিয়ে যাওয়া শ্রী রাম পদরথ নামের একজন ভারতীয়
চাপরাশী তার সাইকেলের চাকার আঘাতে সেই বোমার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে মারা যান।
বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসের জন্ম ১৮৯৫ সালের ৬ ই ফেব্রুয়ারি
নদীয়া জেলার অন্তর্গত পোড়াগাছা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মতিলাল বিশ্বাস। নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানকারী প্রধান নেতা দিগম্বর বিশ্বাস তার পূর্বপুরুষ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষ করে স্বর্গীয়
শ্রী রূপলাল খাঁর তত্ত্বাবধানে আবাসিক ছাত্র হিসাবে বসন্ত বিশ্বাস মুড়াগাছা সর্বার্থ
সাধক বিদ্যালয়ে (মুড়াগাছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ) ভর্তি হয়েছিলেন। প্রধান শিক্ষক মহাশয়
শ্রী ক্ষীরোদ গঙ্গোপাধ্যায় বসন্তকে খুবই স্নেহ করতেন। ছোট থেকেই বসন্ত ছিলেন বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন। ছাত্রাবস্থায় তাঁর শিক্ষক ছিলেন ক্ষীরোদচন্দ্র গাঙ্গুলি,
মূলত তাঁর প্রভাবেই বসন্ত বিপ্লবী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। এরপর যুগান্তর গোষ্ঠীর কর্মী
অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে বসন্তের পরিচয় হয়। তিনি বসন্ত বিশ্বাসকে বোমা বানানো আর বোমা ছোড়া শেখান। ১৯১১ সালের শেষ দিকে রাসবিহারী বসুর সাথে 'বিশে দাস' ছদ্মনাম নিয়ে তিনি উত্তর ভারত চলে যান। পরে দেরাদুনের
‘টেগোর ভিলা’র বাগানে রাসবিহারী নিজে বসন্তকে
আরও পারদর্শী করে তুলেছিলেন। বসন্তের সাহসিকতা, নিষ্ঠা, উদ্যম আর বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে বসন্ত বিশ্বাসকে
রাসবিহারী বসু পাঁচ-সদস্যের গুপ্তচক্রের অন্যতম সদস্য মনোনীত করেন।
দিল্লীতে বড়লাটকে মারার জন্য ১৯১২ সালের ২৩ শে ডিসেম্বরের
বোমা আর লাহোরে লরেন্স গার্ডেন্স-এর নাইট ক্লাবের রাস্তায় রাখা
১৯১৩ সালের ১৭ ই মে-র বোমার উপাদানগুলো পরীক্ষা করে পুলিশ বুঝতে পারে
যে দুটোই একই জায়গায় তৈরী। তাছাড়া এগুলোর সাথে কলকাতায় উদ্ধার করা বোমার উপাদান ও চরিত্রগত মিলও জেনে ফেলে। কাজেই পুলিশ নিশ্চিত হয়ে যায় যে বোমাদুটো বাংলায়
প্রস্তুত হয়েছে এবং বাংলার বিপ্লবীদের হাত রয়েছে এই দুই ঘটনায়। এর ফলে বাংলায় ব্যাপক তল্লাসী ও ধরপাকড় শুরু হয়। বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক টাকার পুরস্কারও
ঘোষণা করা হয়।
কলকাতায় রাজাবাজারের এক মেসে তল্লাসীর পর পুলিশের
হাতে বিপ্লবীদের কিছু চিঠিপত্র আসে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাসবিহারী বসু যে উত্তর ভারতের বিপ্লবীদের প্রধান নেতা তা
পুলিশের জানা হয়ে যায়। পুলিশ বিপ্লবী বসন্ত
বিশ্বাসের কথাও জানতে পারে। প্রিয় শিষ্য বসন্ত বিশ্বাসকে সঙ্গে করে নিয়ে ছদ্মবেশে রাসবিহারী
দিল্লী পৌছে দেখেন স্টেশনের ঠিক বাইরে দেওয়ালের গায়ে লাগানো রাসবিহারীর ছবিসহ পুরষ্কার
ঘোষণার নোটিস। রাসবিহারী ও অন্যান্যদের
সন্ধান দেবার জন্য এক লক্ষ টাকার পুরষ্কার ঘোষণা করেছে সরকার।
রাসবিহারী তাঁর প্রিয় শিষ্য বসন্ত বিশ্বাসকে নিয়ে
চলে যান চন্দননগরে। কিছুদিন আত্মগোপন করে
থাকার সময় বসন্তকুমার বিশ্বাসের পিতৃবিয়োগ হয়েছে বলে জানতে পেরে তিনি চলে আসেন গ্রামের
বাড়ি নদীয়া জেলার পোড়াগাছায়। গ্রামের বাড়িতেই শ্রাদ্ধক্রিয়া করা হবে বলে স্থির হয়। কিন্তু ক্ষৌরকর্মের আগের দিন কিছু বিশেষ কাজে বসন্ত
বিশ্বাস কৃষ্ণনগরে কাকা প্রতাপচন্দ্রের বাসায় আসেন। সেদিন ছিল ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৯১৪। সেই বাসায় সদ্য পিতৃহারা বসন্তের যখন হবিষ্যি গ্রহণের
উদ্যোগ চলছিল ঠিক তখনই পুলিশ বাড়িটিকে ঘিরে ফেলে। নির্ভীক চিত্তে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস মাত্র ১৯ বছর
বয়সে চলে যান ব্রিটিশের কারাগারে।
১৯১৪ সালের ২৩ শে মে দিল্লিতে দিল্লি-লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ৫ ই অক্টোবর বসন্তকুমারকে যাবজ্জীবন
কারাদন্ড দেওয়া হয়। ঐ দলের দীর্ঘদিনের সহযোগী
দীননাথ ও সুলতানচাঁদ নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে ইংরেজ শাসকদের প্ররোচনায় বিশ্বাসঘাতকতা
করে রাজসাক্ষী হয়ে অনেক গোপনীয় কথা আদালতে ফাঁস করে দেয়। দীননাথ ১৯১২ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর দিল্লীতে বড়লাট
লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর বোমা বিস্ফোরণে রাসবিহারী বসু, বসন্ত বিশ্বাস ও অন্যান্যদের যুক্ত থাকার কথাও ফাঁস করে দেয়। দিল্লীতে ভাইসরয়ের (বড়লাট-এর) উপর বোমা-নিক্ষেপের দিনকয়েক বসন্ত বিশ্বাস যে লাহোরে ছিলেন না তাও ফার্মেসীর ক্যাশ রেজিস্টার
থেকে প্রমাণ হয়ে যায়। কিন্তু শুধুমাত্র লাহোরে
অনুপস্থিতির জন্যই তাঁকে দিল্লী বোমা বিস্ফোরণের আসামী বলে আইনগতভাবে অভিযুক্ত বলে
প্রমাণ করে না। 'দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র' মামলায় দিল্লী আদালতের এডিশানেল সেশন্স জাজ মি: এম. হ্যারিসন তার ৫ ই অক্টোবর ১৯১৪ এর রায়ে তিনজনকে প্রাণদণ্ড
আর অপর তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। অনেকেই জানেন না প্রথমে বসন্ত বিশ্বাসকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
স্বভাবতই নাবালক প্রধান অভিযুক্তের প্রাণদণ্ড না
হওয়ায় প্রতিহিংসা পরায়ণ ইংরেজ শাসকরা এই রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ইংরেজ সরকার দিল্লী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে লাহোরে
পাঞ্জাব উচ্চ আদালতে আবেদন করে। আরো একবার বিচারের নামে প্রহসনের শেষে ১৯১৫ সালের ১০ ই ফেব্রুয়ারি বিচারক স্যার
ডোনাল্ড জনস্টোন ও মি: রেটিগান দিল্লী আদালতের দেওয়া
শাস্তিকে পরিবর্তন করে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। দিল্লী আদালতের বিচারক হ্যারিসনও এই ঘৃণ্য চক্রান্তে
জড়িত ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার
জন্যে তিনি ফাইলে বসন্ত বিশ্বাসের বয়স দুবছর বাড়িয়ে ২৩ বছর করেন এবং প্রমাণ করেন
তিনি তাঁর কৃত অপরাধের তীব্রতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন।
১৯১৫ সালের ১১ ই মে বসন্তকুমার বিশ্বাস অত্যন্ত শান্ত
ও অবিচলিত মনে ফাঁসির মঞ্চে উঠেন। পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে মাত্র ২০ বছর বয়সে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ে বসন্ত ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ আত্মত্যাগী হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
দেশ কোনোদিনও বসন্ত বিশ্বাসকে প্রাপ্য সন্মান দেয়নি।
“দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র” মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত শহীদ বালমুকুন্দ ও শহীদ অবোধবিহারীর ছবি দিল্লীর সংসদ
ভবনের মিউজিয়ামে থাকলেও আজ অবধি শহীদ বসন্ত বিশ্বাসের কোন ছবি সেই সংগ্রহশালায় নেই। যদিও দুই মামলাতেই তাঁর ভূমিকা ছিল প্রধান। কলকাতা নিবাসী শ্রী শংকরেশ্বর দত্ত মহাশয় নিজ উদ্যোগে
২০১০ সালে তদানীন্তন লোকসভার মাননীয়া স্পীকার মীরা কুমার মহোদয়াকে চিঠি লেখার পরও তাঁর
ছবি মিউজিয়ামে স্থান পায়নি। একটা ভিডিও-ক্লিপে শুধু শহীদ বসন্তকুমার বিশ্বাসকে কিছুক্ষণ
মিউজিয়ামে দেখা যায়।
বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তাঁর প্রিয় শিষ্য বসন্ত বিশ্বাসকে
কখনও ভুলে যাননি। জাপানের টোকিও শহরে মাদাম
তেৎসু-কোং হিওচির বাগানে রাসবিহারী নাকি নিজহাতে একটা ওক
গাছের ফলক প্রোথিত করে স্মারক হিসাবে বসন্তের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান জানিয়েছিলেন। বসন্ত বিশ্বাসের নিজের স্কুল মুড়াগাছা উচ্চ মাধ্যমিক
বিদ্যালয়ের মাঠেও আছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি এবং ফলক| এছাড়া স্কুলের ছাত্রাবাসের নামকরন করা হয়েছে ‘বসন্ত ছাত্রাবাস’। তাঁর আরেকটি আবক্ষ মূর্তি
আছে কৃষ্ণনগরে রবীন্দ্র ভবনের পাশে।
দেশ বসন্ত বিশ্বাসকে প্রাপ্য সন্মান দেয়নি,তিনি অধিকাংশ বাঙালির মনের অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছেন। তিনি বাংলার বীর সন্তান। তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব।
জয় বাংলা।
তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, উৎপল আইচের ফেসবুক পোস্ট
Post a Comment