হীরকরাজা (উৎপল দত্ত) বাংলা ও বাঙালির গর্ব
‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়। নিজের সম্পর্কে এভাবেই বলেছিলেন উৎপল দত্ত। ‘হীরক রাজার দেশে’ র হীরকরাজা, ‘জয়বাবা ফেলুনাথে’ র মগনলাল মেঘরাজ, ‘আগন্তুক’ এর মনোমোহন মিত্র, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ র হোসেন মিয়া, ‘অমানুষ’ এর মহিম ঘোষাল, ‘দো আনজানে’ র
চিত্র পরিচালক, ‘জনঅরণ্যে’ র বিশুদা এমনি কত চরিত্রেই না অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। তিনি কেবল অভিনেতা হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাঙালি নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যতজ্ঞ ও সম্পাদক। তিনি বাংলার শিল্পাঙ্গনে এক বিরাট বিস্ময়! তাঁর সব কিছুকে নিয়ে ভারতীয় নাট্যজগতে যে বিপুল আলোড়ন উঠেছিল, তাঁর সময়কালে আর কোনও নাট্যব্যক্তিত্বকে ঘিরে তেমনটা হয়নি। তাঁর মতো আগে কেউ ছিলেন না, পরেও কেউ আসেননি। পুলিশি নির্যাতন, কারাবাস, দুষ্কতীদের দিয়ে তাঁর নাটকের উপর আক্রমণ, কোনও কিছুই থামাতে পারেনি সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এই নাট্যব্যক্তিত্বকে। যেমন ছিলেন মঞ্চে, তেমনি ক্যামেরার সামনে;
ঠিক তেমনি নিজেকে অমর করে রেখেছেন নাট্যকার হিসেবে। তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব।
পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ, বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কীর্তনখোলায়। যদিও তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লা জেলায়। কিন্তু তিনি নিজে তাঁর জন্মস্থান শিলংয়ে তাঁর মামার বাড়িতে বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন। তাই সঠিক বলা দুষ্কর আসল জন্মস্থানটি কোথায়। উৎপলের বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা শৈলবালা রায়ের (দত্ত) পাঁচ পুত্র, তিন কন্যার মধ্যে উৎপল ছিলেন চতুর্থ সন্তান। পারিবারিক ধর্মগুরু তাঁর ডাকনাম রেখেছিলেন শঙ্কর। বাবা গিরিজারঞ্জন ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ প্রভাবিত
সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ। তিনি পরবর্তী কালে জেলার হিসেবে
ইংরেজ কারাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক (কমান্ড্যান্ট)
নিযুক্ত হন। উৎপলের স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল
শিলং শহরের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে। পরে গিরিজাশঙ্কর বদলি হয়ে আসেন
বহরমপুর শহরে। এখানেই উৎপলের ছেলেবেলার দিনগুলো
কেটেছিল। ছোট ভাই নীলিন ও তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট
স্কুলের ছাত্র ছিলেন। বিপ্লবীদের ভয়ে স্কুলে যাতায়াতের
সময়ে তাঁদের সঙ্গে দেহরক্ষী থাকত। জেলের পাঠান রেজিমেন্টের জওয়ানদের
সঙ্গে উৎপল ড্রিল করতেন। এই সঙ্গই তাঁকে সময়ানুবর্তিতা
শিখিয়েছিল। জেল-সংলগ্ন কোয়ার্টারে সপরিবার
তাঁরা থাকতেন। বাড়ির সদর দরজায় মা শৈলবালার
হাতে তৈরি এমব্রময়ডারি করা শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের পেমেনিয়াসের সংলাপ ঝুলত, ‘নেভার কোয়ারেল,
নেভার লেন্ড অর বরো ইফ ইউ আর অনেস্ট।’ বোঝাই যায়, বাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবেশে শেক্সপিয়রের উপস্থিতি
ছিল অগ্রগণ্য। মেজদা মিহিররঞ্জন কিশোর উৎপলকে
শেক্সপিয়রের নাটকের গল্প পড়ে শোনাতেন। বাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে
নাটক শোনার চল ছিল। উৎপল সে সব নাটক মন দিয়ে শুনতেন। তাই তিনি মাত্র ছ’বছর বয়সেই শেক্সপিয়রের নাটকের সংলাপ মুখস্থ বলতে
পারতেন। বড়দিদির মাধ্যমে হিন্দুস্তানী মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে
পরিচয় বহরমপুরের বাড়িতেই। আরও পরে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স
কলেজে পড়ার সময়ে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের সংস্পর্শে আসেন। তখনও নাটক তাঁকে টানেনি। তিনি চেয়েছিলেন কনসার্ট পিয়ানিস্ট
হতে। কিন্তু শিক্ষিকা মিসেস গ্রিনহল তাঁকে বলেছিলেন,
তাঁর হাতের আঙুলের দৈর্ঘ্য বা ‘রিচ’ কম হওয়ায় তাঁর পক্ষে কনসার্ট পিয়ানিস্ট হওয়া সম্ভব
নয়।
এর পরে তিনি চলে আসেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে,
নবম শ্রেণিতে। এই স্কুল ও কলেজ জীবন উৎপল দত্তকে
তৈরি করে দিয়েছিল। ১৯৪৫-এ তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলেজে তাঁর কাছে সবচেয়ে
আকর্ষক ছিল গ্রন্থাগারটি। বিভিন্ন বিষয়ের বই তাঁর সামনে
মেলে ধরেছিল জ্ঞানের বিপুল ভাণ্ডার। বন্ধু পুরুষোত্তম লালের ভাষায়,
“উৎপল হল বর্ন ব্রিলিয়ান্ট। ওই বয়সেই সে শেক্সপিয়রের জগৎকে যেমন আবিষ্কার করেছিল, তেমনই মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন, হেগেল, কান্টও তাঁর আয়ত্তে ছিল।” কলেজ পত্রিকার জন্য তিনি ‘বেটি বেলশাজার’ নামে প্রথম ইংরেজি নাটকটি লিখেছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়
নিয়েও লিখতে শুরু করেন। সেখানে যেমন ছিল শেক্সপিয়র,
বার্ট্রান্ড রাসেল, রুশ সাহিত্য,
তেমনই রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র,
শরৎচন্দ্র| ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগোলের
‘ডায়মন্ড কাট্স ডায়মন্ড’ এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কলেজজীবনে উৎপলের নাট্য অভিনয়ের শুরু। তাঁর সহপাঠী অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন প্রতাপ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এই বন্ধুদের নিয়েই তিনি তৈরি
করেন তাঁর প্রথম নাট্যদল ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিরিয়নস’। কারণ, দিন বদলের দামামা উৎপল তত দিনে শুনে ফেলেছিলেন। তাঁর কলেজ জীবনের সময় কালে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর চারের দশক জুড়ে বিশ্বযুদ্ধ,
ভারত ছাড়ো আন্দোলন, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, উদ্বাস্তুদের ঢল, গণনাট্য, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, নৌ-বিদ্রোহ ইত্যাদিতে সারা দেশ উত্তাল। সেই রাজনৈতিক,
সামাজিক পরিবেশ উৎপলকে বাধ্য করেছিল তত্ত্বগত ভাবে আয়ত্তে থাকা
মার্ক্সের দর্শনকে নাট্যমঞ্চে প্রয়োগের স্তরে নিয়ে আসতে। ১৫ ই জুলাই, ১৯৪৯ জেভিয়ার্সের মঞ্চে তিনি শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ উপস্থাপন করলেন চরিত্রদের ইতালীয় ফ্যাসিস্ত শাসকের
পোশাক পরিয়ে। সমকালীন মাত্রা পেল শেক্সপিয়রের নাটক। জিয়োফ্রে কেন্ডাল ও শেক্সপিয়রানা নাট্যদল সেন্ট জেভিয়ার্সে থাকাকালীনই শেক্সপিয়রের
‘রিচার্ড দ্য থার্ড’ এ উৎপলের অভিনয় দেখে
মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের দলে টেনে নেন জিয়োফ্রে কেন্ডাল। ‘দ্য শেক্সপিয়রানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’তে অভিনেতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন উৎপল। প্রথম পর্বে কলকাতা ও দ্বিতীয় পর্বে সারা দেশ ঘুরে তিনি এই দলের পেশাদার অভিনেতা
হিসেবে শেক্সপিয়রের মোট আটটি নাটকে অভিনয় করেন। জিয়োফ্রেকে শিক্ষাগুরু মনে করতেন উৎপল। শেক্সপিয়রের নাটকে ঠিক
কী ভাবে অভিনয় করতে হয়, নাটকের দল বলতেই বা কী বোঝায়,
তা তাঁকে হাতেকলমে শিখিয়েছিলেন জিয়োফ্রে।
শেক্সপিয়রানা দলের হয়ে অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের
‘দ্য অ্যামেচার শেক্সপিরিয়ানস’ নাট্যদলের হয়েও অভিনয় করে যাচ্ছিলেন উৎপল। ১৯৪৯ সালে এই দলের নাম বদলে হয় ‘কিউব’। ১৯৫০ এ ইউরোপ ও আমেরিকার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবারও দলের
নাম বদলে করেন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। ১৯৫২ সালে এই দলে যোগ দেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের
মতো অভিনেতারা। এর পরই বাংলা নাটকের দল হিসেবে
‘এল টি জি’ পাকাপাকি ভাবে আত্মপ্রকাশ করে
হেনরিক ইবসেনের বাংলা অনুবাদ ‘গোস্টস্’ নাটকটি দিয়ে।
উৎপল দত্ত হলেন বাংলা পথনাটকের পথিকৃৎ। তাঁর মতে, “পথনাটিকা হচ্ছে সেই মাধ্যম যেখানে লক্ষ মেহনতী মানুষের
রাজনৈতিক চেতনা ও অভিনেতার রাজনৈতিক উপলব্ধি এক হয়ে বিস্ফোরিত হয় মঞ্চে।” সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শ্রেণির হাত ধরেই এর উঠে আসা। ১৯৫১ সালে উমানাথ ভট্টাচার্যের এক রাতের মধ্যে লেখা ‘চার্জশীট’ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রথম পথনাটক। যা অভিনীত হয়েছিল হাজরা পার্কে। যেখানে অভিনয় করেছিলেন উৎপল
দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, মমতাজ আহমেদ ও পানু পাল। ১৯৫২ সালে ‘পাসপোর্ট’ থেকে ১৯৯২ সালে ‘সত্তরের দশক’ পর্যন্ত দীর্ঘ একচল্লিশ বছরে উৎপল দত্ত মোট ২৫টি
পথনাটক করেছিলেন কখনও কোনও কারখানার গেটে, নির্বাচনী জনসভায় বা
বন্দিমুক্তি আন্দোলনে উত্তাল বাংলার বিভিন্ন মাঠে ময়দানে।
এল টি জির সদস্যরা মিনার্ভা ও অন্যান্য মঞ্চে নাটক
করে যাচ্ছিলেন। এমনই এক সময়ে ধানবাদ অঞ্চলের
জামাডোবায় চিনাকুড়ি ও বড়াধেমো কয়লাখনিতে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। খাদে আগুন ধরে যায়। মালিক আটকে পড়া শ্রমিকদের কথা
না ভেবে জল ঢুকিয়ে খনি বাঁচাতে চেষ্টা করেন। শ্রমিকরা মারা যান। এই দুর্ঘটনার খবর রবি ঘোষ তাঁর এক আত্মীয় মারফত নিয়ে আসেন উৎপলের কাছে। খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান সেই কয়লাখনিতে। সঙ্গে তাপস সেন,
নির্মল গুহরায়, উমানাথ ভটাচার্য,
রবি চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। হাজার ফুট নীচের সেই খনিগহ্বরে তাঁরা দু’ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়ান। জীবিত খনি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা
বলেন। খনির ভিতরের বিভিন্ন শব্দ রেকর্ড করেন। তার পরে সেখান থেকে ফিরে মিনার্ভার তিনতলার ঘরে বসে টানা ১৫ দিনে লিখে ফেলেন কালজয়ী
নাটক ‘অঙ্গার’।
১৯৫৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর এই নাটক প্রযোজনার কাহিনি আজ বাংলা
নাট্যজগতে মিথে পরিণত হয়েছে। এর পরে এল টি জি নাট্যদলকে আর
পিছনে ফিরতে হয়নি। উৎপল দত্ত তার পর থেকে
‘গ্যালিভার’-এর মতোই বিচরণ করেছেন বাংলার
নাট্যজগতে। এই ভাবেই ক্রমশ মিনার্ভায়
‘ফেরারি ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’,
‘চৈতালী রাতের স্বপ্ন’ ‘প্রোফেসর মামলক’ ইত্যাদি নাটক পার হয়ে ১৯৬৫ সালের ২৮ শে মার্চ মঞ্চস্থ
হয়েছিল আর এক সাড়া জাগানো নাটক ‘কল্লোল’। ১৯৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে
এই নাটক বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে যে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের সূচনা করেছিল, তা আজও নজিরবিহীন। উৎপল দত্তের বয়স তখন ৩৬।
স্বাভাবিক কারণেই ‘কল্লোল’-এর বিরুদ্ধে সরকারি ক্রোধ নেমে এসেছিল। পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রে নাটকটি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বলা হয়েছিল, মিনার্ভা থিয়েটার ‘কমিউনিস্টদের বেলেল্লাপনার আখড়া’য় পরিণত হয়েছে। এই নাটকের বিজ্ঞাপন ছাপা নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন কলকাতার প্রায় সব খবরের কাগজ। কিন্তু তাপস সেনের করা ‘কল্লোল চলছে চলবে’ পোস্টার ও মন্মথ রায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখের পাঠানো
প্রতিবাদপত্রে নাটকের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর
ভারত রক্ষা আইনে উৎপল দত্তকে গ্রেফতার করে জেলবন্দি করা হয়। তাঁর মুক্তির দাবিতে দেশ ও আন্তর্জাতিক স্তরে সরব হয়েছিলেন শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা। কলকাতার রাস্তায় মিছিল বেরিয়েছিল। তাঁর মুক্তির পর ৭ ই মে, ১৯৬৬ ময়দানে আয়োজিত হয়েছিল ‘কল্লোল বিজয় উৎসব’।
নকশাল আন্দোলন উৎপল দত্তকে আগ্রহী করেছিল। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থী মহল প্রশ্ন তুলেছিল। তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে বর্জন করেছিলেন। আন্দোলনের প্রথম সারির
নেতা হিসেবে উৎপল আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। আজীবন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক
ও দায়বদ্ধ শিল্পী নকশাল রাজনীতির জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের ‘তীর’ নাটক যার ফলশ্রুতি। তিনি আবারও সরকারি নজরদারির আওতায় চলে আসেন। তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তাঁকে আত্মগোপন করতে
হয়। ১৯৬৭ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মুম্বাই শহর থেকে তাঁকে
গ্রেফতার করা হয়। একটি ‘আর্মস ডিল’ এর সূত্রে তিনি নাকি মুম্বই গিয়েছিলেন। তখন ইসমাইল মার্চেন্টের ‘গুরু’ ছবিরও কাজ চলছিল। সেই শুটিংয়ের আড়ালে পার্টির
জন্য ওই আর্মস ডিলের কাজ করছিলেন তিনি। তাজ হোটেল থেকেই স্বেচ্ছায়
ধরা দেন উৎপল। কিন্তু বন্দি হয়ে জেলে বসে থাকলে
তাঁর পক্ষে শুটিং চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। অনেক টাকার ক্ষতিপূরণও
দিতে হত। সেই অবস্থা এড়াতে ইসমাইল মার্চেন্ট সরকারি উচ্চমহলে
যোগাযোগ করে অভিনেতার জামিনের ব্যবস্থা করেন। জামিন পাওয়ার শর্ত হিসেবে তাঁকে মুচলেকা দিতে হয় যে, তিনি আর কখনও কোনও রকম রাজনৈতিক নাটক লিখবেন না ও করবেন না। অবশ্য তাও তিনি বাকি জীবনে রাজনৈতিক
নাটক লেখা ও মঞ্চস্থ করা থেকে বিরত হননি।
নকশাল রাজনীতি থেকে পরে নিজেকে সরিয়ে নিলেও উৎপল
দত্ত জীবনের ওই পর্বে ছিলেন রাজনৈতিক ভাবে নিঃসঙ্গ। নিজের দল এল টি জি তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। সেই নিঃসঙ্গতা ও সংকট মুহূর্তে তিনি মঞ্চস্থ করেন ‘মানুষের অধিকার’ নামে আরও একটি কালজয়ী নাটক। যদিও এই নাটক নকশালপন্থীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিল। অতি-বামদের বৈরিতা শুরু হয়। তার প্রভাব এসে পড়ে এল টি জি দলের মধ্যে। সাত সদস্য দলত্যাগ করেন। উপদলের জন্ম হয়। ফলে ১১ বছর ধরে চালিয়ে যাওয়া একটি অন্যধারার পেশাদার থিয়েটারের ইতি ঘটিয়ে উৎপল
দত্ত মিনার্ভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। গড়ে তোলেন ‘বিবেক নাট্যসমাজ’, যা পরবর্তী কালে নতুন দল
‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ বা ‘পি এল টি’ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর রবীন্দ্র
সদনে অভিনীত হয় দলের প্রথম নাটক ‘টিনের তলোয়ার’। এই নাটকে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসটি সুন্দর ভাবে ধরা পড়লেও ‘অশ্লীল’ ঘোষিত হওয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর পরে ‘সূর্যশিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘টোটা’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’,
‘তিতুমীর’, ‘স্তালিন ১৯৩৪’, ‘লালদুর্গ’, ‘জনতার আফিম’ পেরিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেন ‘একলা চলো রে’ নাটকে। যে নাটকে তিনি শেষ বারের মতো মঞ্চে নামেন।
“নাটক ও যাত্রা আমাকে সৃষ্টির আনন্দ দিলেও চলচ্চিত্র
দিয়েছিল বেঁচে থাকার রসদ, মানে টাকা। হিন্দি চলচ্চিত্র আমাকে সর্বভারতীয় অভিনেতা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল।” মধু বসুর ‘মাইকেল’ ছবিতে মাইকেল মধুসূদনের
ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উৎপল দত্তর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা। অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করলেও তাঁর নিজের ভাললাগার ছবিগুলি
তৈরি হয়েছিল অজয় কর, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, শক্তি সামন্তর মতো পরিচালকের ছবি দিয়ে। তিনি যে কত বড় কৌতুকাভিনেতা,
তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে এদের ছবিতে। আবার মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষের ছবিতে তাঁর অভিনয় একেবারে অন্য গোত্রের। মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ তাঁকে চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। তবে যাঁর ছবিকে তিনি বারবার কুর্নিশ করেছেন প্রথম থেকেই, তিনি সত্যজিৎ রায়। ‘পথের পাঁচালি’ বা ‘জন অরণ্য’ দেখে সত্যজিৎকে লেখা তাঁর আবেগরুদ্ধ চিঠি রয়েছে। সত্যজিৎকে তিনি ডাকতেন ‘স্যার’ বলে। সত্যজিৎও মুগ্ধ ছিলেন উৎপলের প্রতিভায়। বলেছিলেন, ‘উৎপল যদি রাজি না হত, তবে হয়তো আমি ‘আগন্তুক’ বানাতামই না।’ ‘আগন্তুক’ ছবিতে উৎপলকে নিজের প্রতিভূ হিসেবেই ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার
জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। হিন্দি ছবিতে কমেডি চরিত্রে
দারুণ জনপ্রিয়তা পান উৎপল দত্ত। কমেডি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য
‘গোলমাল’(১৯৮০), ‘নরম গরম’(১৯৮২) ও ‘রঙ বিরঙ্গি’(১৯৮৭) ছবির সুবাদে তিন বার
ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। ‘সাহেব’(১৯৮৬) ছবিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান ফিল্মফেয়ার আসরে। ১৯৯৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' ছবিতে অভিনয়ের জন্য পান বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট
অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার। থিয়েটারে অবদানের জন্য
১৯৯০ সালে সংগীত নাটক অ্যাকাডেমির ফেলোশিপ পান।
হিন্দি ও বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি ছিলেন দারুণ
জনপ্রিয়। ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আগমন’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অমানুষ’, ‘গুড্ডি’, ‘শৌখিন’, ‘বারসাত কি এক রাত’, ‘চৌরঙ্গি’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘ইনকিলাব’, ‘কিসিসে না কেহনা’, ‘হামারি বহু অলকা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আপনে পারায়ে’, ‘জুলি’, ‘দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার’, ইত্যাদি অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি
ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন এই অভিনেতা। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘অবিচার’-এ খলচরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। গৌতম ঘোষ পরিচজালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি' সিনেমাতেও তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে 'ওথেলো' নাটকের দৃশ্যে উত্তম কুমার অভিনীত কৃষ্ণেন্দু চরিত্রের
নেপথ্য কণ্ঠ ছিল উৎপল দত্তের। কারণ ‘ওথেলো’ নাটকে সে সময় তাঁর বিকল্প অন্য কাউকে ভাবাই যেত না।
বাংলা নাটকে যেমন মাইকেলকে নতুন ভাবে এনেছিলেন গিরীশ
ঘোষ, তেমনই বার্টোল্ড ব্রেখটকে যুক্ত করেছিলেন উৎপল দত্ত। নিজেই বলেছেন, তাঁর উপরে প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল, সোভিয়েত রাশিয়ার নিকোলে পাভলোভিচ অখলোপকভ-এর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সিনেমা নয়, তাঁর আসল জাত চিনিয়েছে নাটক। নির্দেশক উৎপল দত্তর কর্মকাণ্ড শিশির-উত্তর বাংলা রঙ্গমঞ্চকে যতখানি সমৃদ্ধ করেছে, ইতিহাসই সেই অতুলনীয় সম্পদের কোষাগার হয়ে থাকবে।” উৎপল দত্তের সঙ্গে নাটকে কাজ করতে চেয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন সৌমিত্র। আন্তন শেফারের ‘স্লিউথ’ নাটকটি তাঁকে অনুবাদ
করতে দেন উৎপল। কথা ছিল, ওই নাটকে দু’জনে অভিনয় করবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। পরে সেই নাটক ‘টিকটিকি’ নামে সৌমিত্র করেছিলেন কৌশিক সেনের সঙ্গে। উৎপল দত্তের সঙ্গে কাজ করার
স্মৃতি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে নাটক, চলচ্চিত্র ও যাত্রার অনেক অভিনেতা
ও পরিচালকের মনে। কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে হত,
“মহলার সময় বাবা যেন এক যুদ্ধের সেনানায়ক।” অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ তাঁকে গুরু মানতেন। রবি ঘোষ বলতেন, “উৎপল দত্ত ছিলেন সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ ‘স্টেজ স্টলওয়ার্ট’। স্টেজ প্রোডাকশনের এ টু জ়েড
জানতেন। আমার অভিনয়ের বেসিক ট্রেনিং তো ওঁর কাছেই পাওয়া।” তরুণ মজুমদারের মনে আছে, “ওঁর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবির রায় সাহেবের চরিত্রটা এত
পছন্দ হয়েছিল যে, এগ্রিমেন্ট পেপারে সই করে পারিশ্রমিকের জায়গাটা ফাঁকা
রেখে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। ফ্লোরে মেকআপ নিয়ে পাঁচ মিনিট
আগেই উপস্থিত হতেন। হাতে থাকত মোটা মোটা বই। শটের ফাঁকে পড়তেন। ডাক পড়লেই উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন,
‘ইয়েস স্যার’।”
নাট্যচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দীনবন্ধু পুরস্কার,
রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন। নানা অভিমানের জায়গা থেকে ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ উপাধি ও সাহিত্য আকাদেমি
পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৯৩ সালের ১৯ শে অগস্ট ৬৪ বছর
বয়সে উৎপল দত্তর জীবনাবসান হয়।
Post a Comment