হয়তো তোমারই জন্যে.....জন্মশতবর্ষে কিংবদন্তি
'পড়োশন’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার করকে শৃঙ্গারের রেকর্ডিং। সব কিছু ঠিকঠাক। রেকর্ডিংয়ের আগের দিন কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন, এই গান তিনি কিছুতেই গাইবেন না। মান্না দের সঙ্গে ডুয়েট গান। খুব চেপে ধরতে বললেন, “কী করে গাইব বলুন তো? আমি কি আপনার মতো ক্ল্যাসিকাল জানি?” আরও জোরাজুরি করতে বললেন, “ তা ছাড়া কেমন যেন শুনছিলাম, কম্পিটিশনে আমি হেরে যাব!” তারপর কিশোরদা জিভ কেটে বললেন, “আপনার কাছে হারতে আমার আপত্তি নেই মান্নাদা!”
তিনি কথা দিয়েছিলেন, 'আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই
শেষ দেখা নয়তো।' সত্যিই তাই। তিনি মান্না দে। তিনি বাংলা
ও বাঙালির গর্ব।
বাংলা গান যতদিন
থাকবে, মান্না দে ততদিন বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। চলতি বছরের ১লা মে ছিল তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলি, পঞ্জাবি, মারাঠি, কন্নড়, মালায়ালম ও হিন্দি
ভাষায় তিনি ষাট বছরেরও অধিক সময় সঙ্গীত চর্চা করেছিলেন। বৈচিত্র্যের বিচারে তাঁকেই হিন্দি গানের
ভুবনে সবর্কালের সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ সঙ্গীতবোদ্ধারা। সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে
তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন।
সঙ্গীতজগতে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মান দিয়েছে। আবার ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “বঙ্গবিভূষণ” প্রদান করে।
মান্না দে ১ লা মে ১৯১৯ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ছিল প্রবোধ চন্দ্র দে। বাবা পূর্ণ চন্দ্র দে এবং মা মহামায়া দে। তিনি শৈশব পাঠ গ্রহণ
করেছেন ‘ইন্দু
বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি স্কটিশ চার্চ
কলেজিয়েট স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ
কলেজে স্নাতক শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। সংগীত জগতে আসবেন
না আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করবেন- এই নিয়েও নাকি দ্বন্দ্ব ছিল মান্না দের মনে। তবে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র চাইতেন ভাইপো গান করুক। কাকার
ইচ্ছেতেই তাঁর গানের
জগতে আসা। সেক্ষেত্রে গায়ক না হলে হয়তো কালো কোর্ট গায়ে চাপিয়ে আদালতে সওয়াল-জবাব করতে দেখা যেত তাঁকে। প্রথমে কাকা কৃষ্ণচন্দ্রর কাছে গানের তালিম নেওয়া
শুরু করলেও পরে একাধিকজনের কাছেই তিনি তালিম নেন। উস্তাদ আমান আলি খান এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের
কাছ থেকে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম
নেন তিনি। গান গেয়ে
বিখ্যাত হলেও প্রথম
দিকে খেলাধূলাতেও বেশ আগ্রহ ছিল। যৌবনে কুস্তি, বক্সিংয়ের মতো খেলায় পারদর্শী ছিলেন
মান্না দে। তাছাড়া ফুটবলও খেলতেন তিনি।
‘তামান্না’ (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দের অভিষেক ঘটে। সুরাইয়ার সাথে দ্বৈত
সঙ্গীতে গান এবং সুরকার ছিলেন
কৃষ্ণ চন্দ্র দে। ঐ সময়ে গানটি
ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 'মশাল' (১৯৫০) ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। এর গানের কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে
একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ গান। এরফলেই তিনি প্রতিষ্ঠিত ও পাকাপোক্ত করেন এবং জনপ্রিয় গায়ক
হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান।
মান্না দে ভীমসেন জোসির সাথে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত
গান ‘কেতকী
গুলাব জুহি’ গান। এছাড়াও, তিনি কিশোর
কুমারের সাথে আলাদা
গোত্রের দ্বৈত গান হিসেবে ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহী তোড়েঙ্গে (শোলে)’ এবং ‘এক চতুর নার (পডোসন)’ গান। এছাড়াও, মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কুমার) সহ আরো বেশকিছু গীতিকারের সাথে বাংলা ছবিতে
গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মঙ্গেশকরের সাথে ‘কে প্রথম
কাছে এসেছি (শঙ্খবেলা)’ গান করেছেন। মান্না দে রাজেশ খান্নার বিরাট ফ্যান ছিলেন। গানকে
যেভাবে রাজেশ তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্সে ফুটিয়ে তুলতেন, সেটাই তাঁর বিশেষ
পছন্দের বিষয় ছিল বলে বার বার বলেছেন কিংবদন্তি গায়ক। পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর সঙ্গে মান্না দে দ্বৈত সঙ্গীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯৫৬ সালের ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে। গানটি ছিল— ‘কেতকী গুলাব জুহি’ । হরিবংশ রাই বচ্চনের ‘মধুশালা’ কাব্যের গীতিরূপে প্রধান গায়ক ছিলেন
তিনিই।
কেরলের মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৮ ই ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে
করেন। তাদের দুই কন্যা রয়েছে: শুরোমা (জন্মঃ ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে) এবং সুমিতা (জন্মঃ ২০ জুন ১৯৫৮ সালে) জন্মগ্রহণ করে। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ব্যাঙ্গালোরের কালিয়ানগর শহরে বাস করেছেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতায়ও বাস করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন।
তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য গান হল-
- কফি হাউসের সেই আড্ডাটা
- জীবনে কী পাবো না
- জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় প্যাহেলি
- পুছনা ক্যায়সে ম্যায়নে
- হয়তো তোমারি জন্যে
- আবার হবে তো দেখা
- এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি
- তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়
- যদি কাগজে লেখো নাম
- সে আমার ছোট বোন
- আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি
২০১৩ সালের ৮ই জুন ফুসফুসের জটিলতার জন্য মান্না দে ব্যাঙ্গালোরে একটি হাসপাতালের আইসিইউ তে ভর্তি হন। তারপরের দিন ৯ই জুন,তার মৃত্যুর গুজব রটে। ডাক্তাররা এই গুজবের অবসান
ঘটান এবং নিশ্চিত করেন যে তিনি তখনও বেঁচে
আছেন তবে তাঁর অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে এবং আরও কিছু নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। পরে ডাক্তাররা তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানান। মান্না দে ২৪শে অক্টোবর ২০১৩ সালে ব্যাঙ্গালোরে মৃত্যুবরণ করেন।
২০০৫ সালে বাংলাভাষায় তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ খ্যাতিমান আনন্দ প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজীতে ‘মেমরীজ কাম এলাইভ’, হিন্দীতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুদিত হয়েছে। মান্না দের জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্না দে সঙ্গীত একাডেমী মান্না দের সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষন করছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা সঙ্গীত ভবনে মান্না দের সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
মান্না দে যখন গাইতে এলেন কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ রফি, মুকেশে আবিষ্ট আমাদের দেশ। যাঁদের গলাই আগে আমাদের হৃদয়ে
পৌঁছে যায়। সেখানে মান্না দে শুধুমাত্র নিজের পরিশ্রমে, সাধনায় ভারতবর্ষে নিজের পরিচিতি তৈরি করলেন! মান্না দে আসলে এক জন নয়। তিনি সঙ্গীতের নানা রং, সেই রঙে মনকেমন, ‘পুছনা ক্যায়সে ম্যায়নে,’ আবার কখন এই প্রজন্মের হুল্লোড় ‘জীবনে কী পাবো না’ কখনও বা কফি হাউসের ঝড়, কখন ভিতর শূন্য করে দেওয়া হাহাকার, “ক” ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে?”
তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব । আমরা ধন্য, তিনি এই বাংলায় জন্মেছেন।
তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার
Post a Comment