বঙ্গ ক্রিকেটের বিস্মৃত মহানায়ক
১৯৫২ সালে ১০ই ফেব্রুয়ারি। প্রায় ৬৭ বছর আগের কথা। চেন্নাইয়ে কর্পোরেশন স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডকে
হারিয়ে প্রথম বার টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। এক ইনিংস ও ৮ রানে। ওপেন
করতে নেমে সেই টেস্টে ১১১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন এক বঙ্গসন্তান। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি পার্কে একরকম নিজে
নিজেই খেলা শেখেন তিনি। বাঙালি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সফল হতে পারে সেটা তিনি চোখে
আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গ ক্রিকেটের পিতামহ, কিংবদন্তি পঙ্কজ রায়। হেলমেটহীন খালি মাথায়, চশমা চোখে পঙ্কজ টেস্ট জীবনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ
পেসারদের বিরুদ্ধে ব্যাট করেছেন।
বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুলের সাবেক জমিদার পরিবারে ১৯২৮ সালের ৩১শে মে ভারতীয় ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের জন্ম। তাঁর পিতার নাম ছিল বরুন রায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সময়কালে পঙ্কজ রায় ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি বাংলা দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ছিলেন ডানহাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান। এছাড়াও ডানহাতি মিডিয়াম পেসার হিসেবেও সুনাম ছিল তাঁর।
পঙ্কজ রায় ভারতের হয়ে ৪৩টি টেস্ট খেলেছেন। ৭৯টি ইনিংসে তাঁর মোট রান ২৪৪২। বাংলার এই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের টেস্টে সর্বাধিক রান ১৭৩। তাঁর ব্যাটিং গড় ৩২.৫৬। পাঁচটি শতরান ও ন’টি অর্ধ-শতরানের মালিক পঙ্কজ রায়। বাংলা ক্রিকেট দলের পক্ষে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। উদ্বোধনী খেলাতেই তিনি সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখান। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বমোট তিনি ৩৩টি শতকের সন্ধান পেয়েছেন। ১৮৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৪২.৩৮ গড়ে তিনি ১১৮৬৮ রান করেছিলেন। ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিল্লিতে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল পঙ্কজ রায়ের। অভিষেক ইনিংসটিতে মাত্র ১২ রান তুললেও ঐ সিরিজে তিনি দুইটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ টেস্ট খেলেছিলেন মুম্বইয়ে। একটি মাত্র টেস্টে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পঙ্কজ রায়। ১৯৫৫-৫৬ সালে চেন্নাইয়ে সফরকারী নিউজিল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে ওপেনিং জুটিতে বিনু মানকড়ের সঙ্গে পঙ্কজ রায় ৪১৩ রান যোগ করেছিলেন। টেস্টে ওপেনিং জুটিতে এটি সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড ছিল যা ২০০৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৫২ বছর অটুট ছিল। ২০০৭-০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনিং জুটি গ্রেইম স্মিথ (২৩২) ও নিল ম্যাকেঞ্জি (২২৬) ৪১৫ রান তুলে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েন।
পঙ্কজ রায়ের শেষ
টেস্ট খেলার ৩৬ বছর পর ক্রিকেটের ধাত্রীগৃহ লর্ডসে টেস্ট আবির্ভাবেই সেঞ্চুরি করেন
বেহালার এক বাঁ-হাতি। কাকতালীয়ভাবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেস্ট গড় ছিল ৪২, পঙ্কজ রায়ের থেকে ১০ বেশি। কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পঙ্কজ
রায় সম্পর্কে বলেছিলেন “হেলমেট ছাড়া আর হেলমেট পরে ব্যাট করা দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা যুগ। পঙ্কজদা সারা জীবন
হেলমেট না পরে টেস্টে ব্যাটিং ওপেন করেছেন। তার জন্য সব সময় আরও ১০ রান ওঁর
প্রত্যেকটা ইনিংসের সঙ্গে যোগ করতে হবে। তার ওপর চশমা পরে খেলতেন। আমি নিজে চশমা
পরি বলে জানি, সেটা কতটা সমস্যার ব্যাপার। আমি না হয় আধুনিক
যুগের সুযোগ নিয়ে সারা জীবন কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে খেলেছি। পঙ্কজদা সেই সুযোগও
পাননি।” মজার কথা, ইডেনে কিন্তু সৌরভের চেয়ে পঙ্কজের টেস্ট পারফরম্যান্স ভাল। অগ্রজের ইডেনে ৬
টেস্টে ৩৫৮ রান। গড় ৩৫.৮০। অনুজের সেখানে ৮ টেস্টে ৪৪০ রান। গড় ৩১.৪২। সেঞ্চুরি
দু’জনেরই একটি করে।
সর্বভারতীয় অনেক
ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুস্তাক আলি, বিজয় হাজারে, বিজয় মার্চেন্ট, পলি উমরিগড়, দাত্তু ফাদকরদের নাম৷ দেশ তো দূরের কথা, নিজের বাংলাতেও পঙ্কজের নামে নেই কোনও
টুর্নামেন্ট৷ সম্প্রতি ইডেনের একটি স্ট্যান্ড পঙ্কজ রায়ের নামে করা হয়েছে। ইডেনের
বাইরের দেওয়ালে রয়েছে তাঁর ছবি। কুমোরটুলি পার্কে পঙ্কজের বাড়ির সামনে তাঁর আবক্ষ
মূর্তি রয়েছে। ৪৩ টেস্টে পাঁচটি সেঞ্চুরি-সহ ২৪৪২ রানের মালিকের সম্মানে শুধু
এইটুকুই! শুধু রান দিয়ে পঙ্কজের ক্রিকেট বাগান সাজালে তা পুরো হয় না। লর্ডসে
ভারতীয় টিমকে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে জাতীয় নির্বাচক কমিটির সদস্য হওয়ার অভিজ্ঞতা
তাঁর৷ সবচেয়ে বড় কথা, বাপু নাদকার্নি থেকে চাঁদু বোর্ডে, ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের কথায় উঠে এসেছে
পঙ্কজের শৈল্পিক ব্যাটিং।
কম বঞ্চনা সহ্য করতে
হয়নি পঙ্কজ রায়কে। দেশের ক্যাপ্টেন হওয়ার পরের ম্যাচে পারফর্ম করার পরও বাদ পড়তে
হয়েছে। জাতীয় নির্বাচক হয়েছেন, কিন্তু কোনদিনও
চেয়ারম্যান হননি। এ সব নিয়ে কখনও কাউকে কিছু বলেননি। মুখ ফুটে বেশি কিছু বলতেন না, বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতেন এসব যন্ত্রনা। নিজের ব্যাপারে একটু উদাসীন ছিলেন। ওই সব ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস রেখে দেওয়া তাঁর স্বভাব ছিল না। তাঁর ক্রিকেট কিট নিয়ে ছেলেও খেলেছেন। তারপর
সে সব কোনওটা ভেঙে গিয়েছে,
কোনটাও কোনও বন্ধু নিয়ে
গিয়েছে। পঙ্কজ রায়ের এসব ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না, তাই আলাদা করে সংরক্ষণর করা হয়নি তাঁর খেলার সরঞ্জাম। কখনওই নিজের ঢাক নিজে
পেটাতে পছন্দ করতেন না তিনি, এমনকি জনসমক্ষে
নিজেকে জাহির করার ব্যাপার ছিল না এই মহান মানুষটির।
তিনি ১৯৭৫ সালে
পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন। তাঁর ভাইপো অম্বর রায় ও পুত্র প্রণব রায়ও ভারতের পক্ষে
টেস্ট ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন। পঙ্কজ রায়ের দু’ভাই যথাক্রমে নিমাই রায় ও গোবিন্দ রায় বাংলার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলোয়াড়
ছিলেন। তাঁরা স্থানীয় ক্লাব টিমে খেলতেন। একই পরিবারে ৫ জন ক্রিকেট খেলোয়াড় থাকায়
এ পরিবারটি “ক্রিকেট পরিবার” হিসেবে কুমারটুলিতে পরিচিত। ৭২ বছর বয়সে কলকাতার কুমারটুলীর নিজ বাড়িতে ৪ ই ফেব্রুয়ারি
২০০১ সালে তিনি মারা যান। পঙ্কজ চলে গিয়েছেন ১৮ বছর হয়ে গেল। তাঁর কীর্তি আজকের
প্রজন্ম হয়তো সে ভাবে জানেই না। এমনকি বহু বাঙালির বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন এই মহান মানুষটি। পঙ্কজ রায়
বাংলা ও বাঙালির গর্ব।
তথ্যসূত্র-
উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়
Post a Comment