বাঙালির শৈশব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট
সেদিন কথা হচ্ছিল কিছু
কচিকাঁচাদের সাথে। কথা প্রসঙ্গে তাদের জিজ্ঞেস করলাম বাঙালি কমিক্সের নায়ক
হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট সম্পর্কে। জিজ্ঞেস করলে
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো । না তাদের মধ্যে কেউই চেনে না হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাটুল দি গ্রেট । এমনকি তাদের নাম অবধি শোনেনি । অথচ হ্যারি পটার
সিরিজের সব বই তাদের নখদর্পনে। স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান সম্পর্কে তাদের জ্ঞান আমাকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। কেউ কেউ আবার
বিরাট বড় ভক্ত ক্যাপ্টেন আমেরিকার। চাচা চৌধুরী, সাবুর গল্পও কেউ কেউ পড়েছে। না আমি কখনই হ্যারি পটার,স্পাইডারম্যান,সুপারম্যান কিংবা ক্যাপ্টেন আমেরিকার বিরোধী নই। এগুলো হয়তো জানা
প্রয়োজন কিন্তু আজকালকার কচিকাঁচাদের হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট এর সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ না জানার আমি প্রবল বিরোধী। এর একটাই কারণ হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট মানে হল বাঙালিয়ানা। হ্যারি পটার,স্পাইডারম্যান,সুপারম্যান, ক্যাপ্টেন
আমেরিকা, চাচা চৌধুরী, সাবুর কাছে কোথাও যেন হেরে যাচ্ছে বাংলার হাঁদা ভোঁদা,
নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট। না গুণগত মানে কখনই হারছে না, হারছে পরিচিতিতে।
হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে বাংলা ও বাঙালির গর্ব নারায়ণ দেবনাথের অমর সৃষ্টি। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়
ধরে তাঁর লেখা ও আঁকা কমিকস ছোট-বড় বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। শুকতারা, কিশোর ভারতী প্রভৃতি কলকাতা ভিত্তিক শিশু-কিশোরদের
পত্রিকায় কমিকস গুলিকে ছোট ছোট খন্ডে নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলা কমিকসের
জগতে নারায়ন দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদক মন্ডলীর উৎসাহে। তাঁর
প্রথম কমিকস হাঁদা ভোঁদা নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সেসময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল
একমাত্র প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ির আঁকা শেয়াল পন্ডিত, যা তখন যুগান্তরে প্রকাশিত হত। হাঁদা ভোঁদা প্রকাশের সাথে
সাথেই পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। নারায়ণ
দেবনাথের প্রথম রঙীন কমিক স্ট্রিপ ছিল বাঁটুল দি গ্রেট। নারায়ণবাবুর কথায়,
কলকাতার কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি
বাঁটুলের কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। নন্টে ফন্টে প্রথম
প্রকাশিত হয় মাসিক পত্রিকা 'কিশোর ভারতী'তে(১৯৬৯)। পরবর্তীতে দেব সাহিত্য কুটির থেকে বই আকারে
প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে রঙিন সংষ্করণও প্রকাশিত হচ্ছে। সত্যি কথা
বলতে গেলে এগুলোই ছিল আমাদের শৈশব এবং কৈশোরের সবথেকে রঙিন অংশ। ছোটবেলায়
আমাদের জন্মদিনের উপহারগুলোর মধ্যে থেকে
রঙিন কাগজ খুলে তখন অন্তত কয়েকটা বাংলা কমিক্সের বই প্রায়ই বেরিয়ে আসত। প্রায়ই বাড়ির বড়রা, আত্মীয়স্বজনরা আমাদের হাতে তুলে দিত এসব বইগুলো। সেই থেকেই ভালোবাসা। অনেকসময় স্কুলের টিফিনের
পয়সা বাঁচিয়ে কিনেছি বাংলা কমিক্সের বই। পাড়ার বুকস্টলে আগাম
তাগাদা দিয়েও রেখেছি অনেকসময়, "কাকু, এ মাসের শুকতারা/কিশোর
ভারতীটা বেরোলে আমার জন্য এক কপি রেখে দিও"!
আচ্ছা, এবার একটু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে নিজেকে প্রশ্ন
করুন তো, কেন আজকালকার কচিকাচারা
কেন হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট চিনবে? অথবা এটা একটু ভেবে দেখুন, আপনি নিজে কিভাবে চিনেছিলেন? নিজে থেকে চিনেছিলেন কি? বোধহয় না। আপনারই
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোনও একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব অবশ্যই ছিলেন, যিনি কখনও না কখনও আপনার হাতে শুকতারার নতুন সংখ্যাটা অথবা
একটা নন্টে ফন্টের কমিক্স বুক তুলে দিয়েছিলেন! সেই থেকেই আমাদের মজ্জায় ঢুকে
গিয়েছিল হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট। কারণ একবার ওই কমিক্স পড়া
শুরু করলে ভালো না বেসে থাকা যায় না। এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন! ঠিক যেভাবে আপনার আগের প্রজন্মের
কেউ আপনার মধ্যে এই স্পিরিটটা জাগিয়ে তুলেছিলেন, আপনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এখনও অব্দি সেটা করতে পেরেছেন
কি? শেষ কবে আপনার পাড়ার/আত্মীয় কোনও শিশুকে
জন্মদিনের উপহারস্বরূপ একটা গল্পের বই/বাংলা কমিকস হাতে তুলে দিয়েছেন? না, অধিকাংশ মানুষই
দেননি। এমনকি অনেকেই নিজের ছেলেমেয়েদেরও উৎসাহ দেননি বাঙালি কমিক্স পড়ার। সমাজের ওই চলমান পদ্ধতিটা আপনাকেও গোলাম বানিয়ে আপনার
মজ্জায় একটা কথা ঢুকিয়ে দিয়েছে, বাংলায় কিছু হয়
না। অবচেতন মনে আপনিও
বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন সেটা। তাই একুশে
ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে বাংলা নিয়ে গদগদ পোস্ট করেও বাংলা কমিক্স পড়তে আপনি আর
কাউকে উৎসাহ দেন না। ফেসবুকে কত সহজে
লিখে দেবেন, "আমার আবার বাংলাটা ছাড়া
আর কিছু আসে না"! খুব ভালো কথা, আসার প্রয়োজনও নেই! কিন্তু যখন প্রশ্নটা উঠবে যে আপনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য
সেই নূন্যতম অবদানটুকুও রেখেছেন কিনা, যাতে সেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোরও "বাংলাটা আসে", প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যাচ্ছে!
Post a Comment